২০১৬ সালে মাস্টার্স পাস করেছেন ফরিদুল ইসলাম। এরপর থেকেই সরকারি চাকরির জন্য লড়ছেন তিনি। কিন্তু হয়নি, সরকারি চাকরির বয়স পেরিয়ে গেছে এরইমধ্যে। এখন ছুটছেন বেসরকারি চাকরির আশায়। ফরিদুল বলেন, সিভিতে যখন বয়স ৩২ দেখে তখন আর কেউ আগ্রহ দেখায় না। ১৫ হাজার টাকার চাকরির ইন্টারভিউতেও বলে, বয়স বেশি অভিজ্ঞতা নাই।
সরকারি চাকরি যেন এখন সোনার হরিণ। সবাই ছুটছেন এর পেছনে। কামিয়াব হচ্ছেন স্বল্পসংখ্যক। বাকিরা ভুগছেন হতাশায়। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ৫.৪ শতাংশ
২০১৯ সালে ছিল ৪.৪ শতাংশ। যেখানে পাকিস্তানে ৪.৩ শতাংশ, নেপালে ৪.৭ শতাংশ, ভুটানে ৩.৬ শতাংশ ও মিয়ানমারে ১.১ শতাংশ।
বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। বর্তমানে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে বছরে ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ। পূর্বে যেটা ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ।
টিউশনি করিয়ে কোনোরকম সংসার চলছে আদনান আহমেদের। তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলেন, আমার ছোট ভাই লেখাপড়া না করে বাবার ওষুধের ব্যবসায় নাম লেখায়। এখন সে প্রতিষ্ঠিত। আমার অনেক বন্ধু আছে যারা শুরুতেই ছোট চাকরিতে যোগদান করে। এখন তারা প্রতিষ্ঠিত। আমি কোনোরকম টিউশনি করিয়ে নিজের হাতখরচ চালাই।
আফনান পিয়াল নামে একই প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েট বলেন, আমি সরকারি চাকরির জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এরপর পরীক্ষা দিয়েছি অসংখ্য। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি চাকরি। এখন চাকরির জন্য গেলে অধিকাংশই সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা বেতনের কথা বলে। এই টাকায় ঢাকায় কাজ করা সম্ভব না। তাই রংপুরে থাকি। এই টাকায় রংপুরে হলেও যোগ দেয়া যেতো। আমার ছোট ভাইয়ের এক ছেলে। আর আমি বিয়েই করতে পারলাম না।
শিক্ষিত বেকারদের বড় একটি অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এর জরিপ বলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস করা শিক্ষার্থীর ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন। এছাড়াও তারা বলছেন, এর অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানেন না তারা অধ্যয়ন শেষে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানে (বেসরকারি) চাকরির জন্য আবেদন করবেন। আবার এই বেকারদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায় প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থী।
আবার করোনাকালে শিক্ষিত তরুণরা অনেকাংশে পিছিয়ে গেছেন। এই সময়ে সামগ্রিক ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসায় অনেকেই নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেননি। সেইসঙ্গে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় তিন বন্ধু মিলে একটি ছোট রেস্তরাঁ দিয়েছিলেন। তাদের একজন সাদমান সাদ বলেন, আমরা পাস করার পরই ২০১৮ সালে রেস্তরাঁ দেই। এরপর করোনার ধাক্কায় রেস্তরাঁটা বন্ধ করে দিতে হয়। এখানে আমরা তিনজনসহ আটজন কাজ করতাম। শুরুতে কয়েকমাস রেস্তরাঁ লোকসানে চালিয়েছি। এরপর যখন আর পারছিলাম না তখন ছেড়ে দেই।
বাংলাদেশে প্রতি বছর চাকরি বাজারে আসে ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ। বৃটিশ ইকনোমিস্ট বলছে, বাংলাদেশের তরুণরা লেখাপড়া শেষে যে চাকরি চাইতে আসে তাদের অর্ধেক বেকার। বাংলাদেশের গ্রাজুয়েট করা ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই বেকার। ভারতে এই হার ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ।
বিডি জবসডটকম’র প্রধান ফাহিম মাশরুর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বেকার সমস্যাকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত চাকরির বাজারে যে ধরনের লোক চাওয়া হয় সেরকম লোক মিলছে না। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত লোক যেভাবে যুক্ত হচ্ছে অধিকাংশরই উপযোগী কোনো চাকরি নাই। তৃতীয়ত, চাকরির বাজারে উৎপাদন ও কৃষিখাতে লোকবল প্রয়োজন হয় বেশি। সেক্ষেত্রে কারিগরি দিকে যোগ্য লোক মিলছে না।
আরিফ হাসান ও আয়েশা হাসান দম্পতি ২০১৮ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন সফটওয়্যার সেবা প্রতিষ্ঠান। হাসান টেক কেয়ারে বর্তমানে কাজ করছেন ১৮ জন শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। আয়েশা হাসান বলেন, আমারা দু’জনই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের লোকের প্রয়োজন হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক গ্রুপে দেই। সর্বশেষ চারজন লোক প্রয়োজন ছিল, সিভি জমা পড়েছিল ৭২টি। এরপর ২৮ জনের ভাইভা নেই। এরপরও আমরা প্রয়োজন মাফিক যোগ্য লোক পাইনি। এমনকি অনার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীর বেসিক ধারণাটুকুও নেই। আমরা চেয়েছিলাম নবীন কিংবা অভিজ্ঞ; কিন্তু বেসিক ধারণা না থাকায় দু’জনের বেশি নিতে পারিনি।
২০২০ সালে যাত্রা করা একটি অনলাইন গণমাধ্যমের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজম্যান্ট’র একজন সদস্য বলেন, আমাদের বিভিন্ন কাজের জন্য আমরা তিন ক্যাটাগরির লোক চাই। ফ্রেশার, অন্তত দুই থেকে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞ ও পাঁচ বছরের অধিক অভিজ্ঞ। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে লেখাপড়া করে আসা শিক্ষার্থীদের সাধারণ একটা হেড লাইন কিংবা ক্যামেরা কীভাবে ধরবে সেই ধারণাটুকুও নাই অধিকাংশের।
এছাড়াও তিনি বলেন, সিভি নিয়েও হতাশ হই অনেক সময়। ইন্টারনেটে অনেক সময় কিছু সিভি পাওয়া যায় সেগুলোর কপি পেস্ট করে দেন তারা। এমনকি সিভিতে কী লেখেন তারা সে বিষয়েও ধারণা তাদের নেই।
সরকারি চাকরির জন্য ছুটে হতাশায় ভোগা ও মূল্যবান সময় নষ্ট করা ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। চট্টগ্রামে স্বামীর সঙ্গে থাকেন বিভাগীয় শহরের এক স্বানামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমার হরমোনের সমস্যা আছে। একবার শারীরিক জটিলতা নিয়ে মায়ের সঙ্গে গাইনি চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। তখন আমি সদ্য বিবাহিতা। বয়স ২২ কিংবা ২৩। ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, দ্রুত সন্তান নিতে। এরপর লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকি। কিন্তু সার্টিফিকেটের বয়স পেরিয়েছে ৩০ বাস্তবে আরও দুই বছর। এখন অনেক চিকিৎসা করেও কনসিভ করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি চাকরিতে যোগদানের আমার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এখন আমি পুরোদস্তুর গৃহিণী। কিন্তু বলা যায়, আমার একুল, ওকুল দুটোই গেল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা সাইফুন কাদির বলেন, আমাদের অনার্স শেষ করতে লেগে গেছে ২৭ বছর। এরপর চাকরি প্রাপ্তিতেও দেরি হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা ৬ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরির চেষ্টা করতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা অভাগা। আমরা সরকারি চাকরির জন্য সময় পেয়েছি মাত্র ৩ বছর। এ সময়ে আমরা কোনো কারিগরি কাজেও ছিলাম না। ফলে ৩০ পেরিয়েও আমার অভিজ্ঞতা শূন্য।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্ব বাড়ার কারণ হচ্ছে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে শিক্ষা দিচ্ছি তা পরিপূর্ণ নয়। শিক্ষার্থীদের শুধু সনদ নিয়ে বের হতে হয়। আমরা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারছি না। এখানে ভাষা দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা শেখানো হয় না। বর্তমান সময়ে বিজনেস কমিউনিকেশন, ডিপ্লোমেটিক কমিউনিকেশন এসব বিষয় খুবই প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসব শিখছে না। ভাষাগত দুর্বলতার কারণেও নিজের যোগ্যতার প্রকাশ করতে পারি না।
সরকারি চাকরি প্রত্যাশীদের বিষয়ে তিনি বলেন, চাকরির বাজার ছোট, সেখানে সরকারি চাকরির বাজার আরও ছোট। যারা সৌভাগ্যবান তারা চাকরি পান। কিন্তু বাজারে চাকরির জন্য যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানো হচ্ছে না। আবার আমাদের দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চাকরি নিয়ে নিচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, কোরিয়ানসহ অন্য দেশের লোকেরা। কারণ আমাদের দেশের চাকরি প্রত্যাশীদের ভাষা দক্ষতা কম, যোগাযোগ দক্ষতাতো আরও সাংঘাতিক রকমের কম।