Saturday, June 10, 2023
spot_img
Homeজাতীয়২০০০ কোটি টাকা তো মামুলি! নানা আলোচনা

২০০০ কোটি টাকা তো মামুলি! নানা আলোচনা

গোয়ালচামট। এখানেই ক’দিন আগে পুড়েছে বরকত-রুবেলের ১২টি বাস। বাসগুলো ছিল জব্দ করা। পুলিশের হেফাজতে। কীভাবে গভীর রাতে আগুনে পুড়লো এতগুলো বাস? এ নিয়ে শহরে নানা প্রশ্ন, তত্ত্ব। পুলিশের অবহেলা, ভূমি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সবকিছুই রয়েছে আলোচনায়। এ এলাকাতেই দেখা যায়, বরকত-রুবেলের একাধিক স্থাপনা। পেট্রোল পাম্প, হোটেল।এইসবও জব্দ। একটি স্থাপনায় অবশ্য সাইনবোর্ড লাগানো, এই সম্পত্তি পূবালী ব্যাংক লিমিটেড ফরিদপুর শাখায় দায়বদ্ধ। জমির পরিমাণ ৯০.২৩ শতাংশ। রুবেল-বরকত গং ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এই অভিযোগও পুরনো। তবে শহর পেরিয়ে বদরপুরে গেলে চোখ কপালে ওঠার দশা। স্থাপনাটি এখন অনেকটাই পরিত্যক্ত। লেখা- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ফরিদপুর থানা শাখা।

এখানে ছিল শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি বহুল আলোচিত সাজ্জাদ হোসেন বরকতের অফিস। স্থানীয়রা জানালেন, নিজের প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস এখানে নিয়ে আসেন বরকত। পাশেই তার বাড়ি। বাইপাস সড়কের পাশে তার একরের পর একর জমি। দুই পাশে দোকানের সারি। এ জায়গা অবশ্য রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য এরইমধ্যে সরকার অধিগ্রহণ করেছে। এই অধিগ্রহণের সময়ও কৌশলে বিপুল টাকা আয় করেন বরকত-রুবেল গং। বিস্ময়কর খবর হলো, বাইপাসের পাশে টিকে থাকা দোকানগুলোর ভাড়া এখনো তুলছেন বরকত-রুবেলের লোকজনই। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামীম হক বলেন, ‘এসব দোকানের ভাড়া এখনো বরকত-রুবেলের আত্মীয়স্বজনরা তুলছেন।’

রুবেল-বরকত কত সম্পদের মালিক: সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের উত্থান রীতিমতো রূপকথার মতো। এই রূপকথার অনেকটাই এখন প্রকাশ্যে। অনেকেরই জানা। তবে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে অনেক। বহু কিছুই দিনের আলোয় আসেনি। কীভাবে তারা আয় করলেন এত টাকা? কত সম্পদ তাদের? দুই/আড়াই হাজার কোটি টাকার? নাকি আরও বেশি। পুরো সম্পদটা কি আসলেই তাদের? জেলা বিএনপি’র সভাপতি সৈয়দ মোদাররেস আলী ইছা বলেন, ‘দুই হাজার কোটি টাকা তো মামুলি। তাদের সম্পদের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।’ তিনি জানান, অনেকগুলো প্রজেক্টে কোনো কাজ না করেই টাকা তুলে নিয়েছেন তারা। জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও একই কথা বলেন।

২০২০ সালের ২৬শে জুন দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি। এ মামলায় গত বছর মার্চ মাসের শুরুতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। সংস্থাটির করা এক আবেদনে বরকত ও রুবেলের ৫ হাজার ৭০৭ বিঘা জমি ইতিমধ্যে ক্রোক করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ৫৫টি গাড়ি ক্রোক করা হয়েছে। এ মামলার চার্জশিটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বরকত-রুবেলরা জমি দখল করে নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করেন। এসব জমির দাম বেশি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণও তোলেন। বরকত ও রুবেল এবং তাদের স্ত্রী, ভাই, শ্বশুর ও মায়ের নামে ৪৮৭টি দলিলে প্রায় ৩৯৩ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চার বছরে এলজিইডি’র ৪৭৫টি ঠিকাদারি কাজ পান বরকত ও রুবেল।

যার আর্থিক মূল্য ৮১২ কোটি টাকারও কিছু বেশি। ওই সময়ে দুই ভাইয়ের নয়টি ব্যাংকের ১৮৮টি হিসাবে ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। এ মামলার চার্জশিটে সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। মামলার বাদী সিআইডি’র পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সহযোগী হিসেবে বাকি ৪১ জনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা মেট্রো) শামসুন্নাহার গতকাল মানবজমিনকে বলেন, আমরা চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি। মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। তবে এ সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য পেলে আমরা খোঁজখবর রাখছি।

বরকত-রুবেলদের সম্পদ আসলে কত এ নিয়ে ফরিদপুরে নানা আলোচনা চলছে। বিশেষকরে জেলা শহরের একজন নেতা, যার উত্থান আকস্মিক তার এত সম্পদ সারা দেশেই বিস্ময় তৈরি করেছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেও অন্যতম মেগা দুর্নীতির মামলা। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘তারা চরমতম দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিল। তারা আওয়ামী লীগ সেজেছিল।’ রুবেল-বরকতদের সম্পদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সঠিক মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে গেছে, এই সিন্ডিকেটের কি আরও সম্পদ রয়ে গেছে? সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি একর সম্পদের দাম কত? এই সম্পদ সবই কি তাদের? সিআইডি’র একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের আরও সম্পদ থাকতে পারে। জমির মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি আসলে জটিল। আমরা জেলা প্রশাসনের কাছে জমির মূল্যের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। যখন থেকে তাদের উত্থান এরপরের সম্পদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালিয়েছি।

আলোচনায় আরও নাম: মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর, সাজ্জাদ হোসেন বরকত, ইমতিয়াজ হাসান রুবেল, নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, এ এইচ এম ফুয়াদ ও আশিকুর ফারহান। এ মামলায় চার আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন- মোহাম্মদ বিন আলী মিনার, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ, তরিকুল ইসলাম ও কামরুল হাসান। তাদের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সে সময় মামলার বাদী আরও ৪১ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে অনুসন্ধানের পরে কী হলো তা স্পষ্ট নয়। সিআইডি’র দুইজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে, এ ধরনের কোনো অনুসন্ধানের ব্যাপারে জানা যায়নি।

তবে অর্থ পাচারের এই মামলাটি এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়িত আরও কিছু নাম ফরিদপুরে আলোচনায় রয়েছে। এতে রাজনীতিবিদ ছাড়াও প্রশাসন ও সাংবাদিকতায় জড়িত কয়েকজনের নামও রয়েছে। ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা ঢাকাভিত্তিক এক সাংবাদিক বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে যুক্ত থেকে ফরিদপুরে তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। তাছাড়া, খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বহিষ্কৃত এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মো. মোকাররম মিয়া বাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কতদূর যাবে? কতটা শুদ্ধ করবে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments