ডা. জাহেদ উর রহমান
হিরো আলমের সিনেমা/অভিনয় আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি তার কোনো গানও। যেমন ভালো লাগেনি বহু ভদ্রলোক/সুশীল পরিচালকের সিনেমা কিংবা সংগীত শিল্পীর গান। হিরো আলমের সিনেমা কিংবা গান যাদের ভালো লাগে তারা দেখুক, শুনুক। সমাজে এই স্পেইসটুকু লাগবেই। এটুকু না হলে তো এই সমাজ একেবারেই অসুস্থ। এক ভদ্রলোক পরিচালকের দৃষ্টিতে হিরো আলম ‘বানর’। কিন্তু আমার কাছে হিরো আলম ভীষণ শক্তিমান একজন মানুষ। তিনি প্রচলিত চিন্তা, প্রচলিত সব মানদণ্ডকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সমাজে নিজের জায়গা করার লড়াই করেছেন
জনাব হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনায় আসছি পরে, তার আগে ফিরে দেখা যাক কয়েকটি ঘটনা। ২০১৯ সালে মাগুরা জেলার পুলিশ কিশোর-তরুণদের চুল কাটার ক্ষেত্রে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল।
বিজ্ঞাপনabout:blankআগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে ব্যাপক মাইকিং, সেলুনকর্মীদের নিয়ে বৈঠকসহ নানা রকম প্রচারণা চালানো হয়েছিল। পুলিশের পক্ষ থেকে সেলুন মালিকদের জানানো হচ্ছিল, কোনো সেলুনকর্মী কারও চুল কিংবা দাড়ি যেন মডেলিং ও বখাটে স্টাইলে না কাটেন। শুধু তাই না, সেলুনে সেলুনে সেই বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল। মডেলিং এবং বখাটে স্টাইল কাকে বলে সেটা আর এক ধরনের ব্যাখ্যাও দিয়েছিল পুলিশ। সেটা হলো-এক শ্রেণির যুবক চুল এমনভাবে কাটেন যে, তাদের দুই কানের উপরের অংশে চুল থাকেই না। কিন্তু মাথার উপরের অংশে ঘন চুল থাকে। এই চুল বেশ দীর্ঘ হয়। হাঁটার সময় কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় এই চুল বাতাসে দুলতে থাকে। কেন এ ধরনের পদক্ষেপ তার ব্যাখ্যাও দিয়েছিল পুলিশ। থানার ওসি বলেছিলেন, ‘মানুষের লাইফস্টাইলের সঙ্গে তার আচরণের নানা যোগসূত্র রয়েছে। অনেকে উদ্ভট পোশাক পরে ও উদ্ভট স্টাইলে চুল কাটে, যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক। সেটি তার জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই ফেলবে। এ কারণে এটি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
সে ক্ষেত্রে সবার আগে জরুরি সচেতনতা। সে কাজটিই আমরা করছি। ইতিমধ্যে এর ইতিবাচক ফলও পাচ্ছে শহরবাসী।’ এবার আসা যাক এই বছরের ঘটনায়। মে মাসে শহরের মহিপাল বিজয় সিংহ দীঘির পাড়ে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১১ জন ছাত্রী ও ১৪ জন ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। এরপর গাড়িতে তুলে তাদের সদর থানায় নেয়া হয়। সেখানে তাদের আটকে রাখার পর অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় দেয়া হয়। আটক শিশু-কিশোরদের বেশির ভাগই শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। থানায় নেয়ার পর তাদের লজ্জায় মুখ ঢাকতে দেখা গেছে। সামাজিক মর্যাদার ভয়ে তাদের চোখে-মুখে ছিল ভীতি-আতঙ্ক। এটা এই বছরের ঘটনা। কিন্তু এমন ঘটনার নিয়মিত বিরতিতেই আসে আমাদের সামনে। জনাব হিরো আলমকে নিয়ে অতি সমপ্রতি ঘটা ঘটনাটির প্রসঙ্গে আসা যাক। একটি টিভির রিপোর্টে দেখলাম, নিতান্ত নিরীহ ভঙ্গিতে হিরো আলম হেঁটে ডিবি অফিসে যাচ্ছেন। এরপর ডিবি’র পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা হয়। ব্রিফিংয়ে হিরো আলমকে‘তিনি’ নয়, ‘সে’ বলে সম্বোধন করা হয় হিরো আলমের প্রতি এমন তাচ্ছিল্য দেখে আমার মনে পড়লো তার প্রতি আরেকটা বীভৎস তাচ্ছিল্যের কথা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ২০১৮ সালের নির্বাচনে হিরো আলম অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সেই নির্বাচনে তার প্রার্থিতার কাগজপত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশন ঝামেলা করেছিল। তারপর হিরো আলম হাইকোর্টে যান এবং প্রমাণিত হন তিনি ঠিক ছিলেন, নির্বাচন কমিশন তার ওপরে অন্যায় করেছে। তার হাইকোর্টে যাওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব। এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সচিব হেলালুদ্দীন বলেন, ‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়। সেও বলে যে “নির্বাচন কমিশনকে আমরা হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়ছি।” বোঝেন অবস্থা! সে তো স্বতন্ত্র প্রার্থী। সে বগুড়া থেকে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁর মনোনয়ন বাতিল করেছে। তারপর আমাদের কাছে আপিল করেছে। মাননীয় কমিশন তার আপিল বাতিল করেছে। সে হাইকোর্টে গিয়ে তাঁরটা ক্লিয়ার করে আসছে। তারপর আগের তালিকার সঙ্গে তার (হিরো আলম) প্রতীক সংযুক্ত করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা আসতেছে। আমরা এগুলো নিয়ে একটু উদ্বিগ্ন এবং ব্যতিব্যস্ত।’ জনাব হেলালুদ্দীন হিরো আলমকে ‘সে’ সম্বোধন করছে। এবং বলছেন ‘হিরো আলম পর্যন্ত’।
প্রশ্ন হচ্ছে হিরো আলমকে কি নির্বাচন কমিশনের সব কথা একেবারে নতশিরে মেনে নিতে হবে? নির্বাচন কমিশনের কোনো আচরণে কি হিরো আলম সংক্ষুব্ধ হতে পারেন না? সংক্ষুব্ধ হলে হিরো আলম কি হাইকোর্টে যেতে পারেন না? একজন সচিব জনাব হেলালুদ্দীন এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের যতটুকুর মালিক, যতটা মৌলিক অধিকার ভোগ করার কথা ঠিক ততটা মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার কি জনাব হিরো আলমের থাকবে না? হিরো আলমের বিরুদ্ধে যে কেউ তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে পারেন কারণ আমরা শিক্ষিত/সুশীল নাগরিকরাও হিরো আলমকে তাচ্ছিল্য করি। হিরো আলম যেদিন থেকে এই জনপরিসরে আসেন সেদিন থেকেই তিনি আমাদের ‘ভদ্রলোক/সুশীল’দের কাছে অচ্ছুত হয়ে ছিলেন। হিরো আলমের মতো একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের, অশিক্ষিত, দরিদ্র, অতি খর্বকায় সারা শরীরে এবং মুখে দীর্ঘকালীন তীব্র অপুষ্টির ছাপ থাকা, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে না পারা একজন মানুষ শিল্পের রাজ্যে প্রবেশাধিকার চাইছে, আমরা মেনে নিতে পারিনি এটা। ঠিক এই পয়েন্টটিতেই আঘাত করতে চেয়েছে পুলিশও। পুলিশকে মুচলেকা দেয়ার পর বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হিরো আলম জানান, পুলিশ তাকে বলেছে- তিনি আয়নায় মুখ দেখেন কিনা, এই চেহারা নিয়ে কীভাবে নিজের নামের সঙ্গে হিরো যোগ করলেন তিনি। পুলিশ এটাও জানতে চেয়েছে তিনি হিরো শব্দের অর্থ জানেন কিনা। জানলে নাকি এই চেহারা এবং এমন বাচনভঙ্গি নিয়ে নিজেকে হিরো দাবি করতেন না।
আমরা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত তারাই মোটামুটি নির্ধারণ করি কে শিল্প করতে পারবে, আর কে পারবে না। আমরা নির্ধারণ করি কার করা কোন কিছু শিল্প হচ্ছে কিংবা হচ্ছে না। আমরাই মূল্যায়ন করে বলি অমুকের শিল্প তমুকের শিল্পের চাইতে ভালো কিংবা খারাপ। আমাদের যাদের সামাজিক পুঁজি অনেক বেশি, তারাই এসব ক্ষেত্রে নির্ধারকের ভূমিকা পালন করি। আমাদের ভূমিকা শুধু নির্ধারক হওয়া পর্যন্ত এসে শেষ হয় না। যার শিল্প হয় না, তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাই। মূলধারার মিডিয়াতেই রিপোর্ট দেখেছি এবার শিল্পী সমিতির নির্বাচনের আগে হিরো আলম যখনই এফডিসিতে গেছেন, তখনই বহু মানুষ তাকে ঘিরে ধরেছে। এমনকি ভিড়ের চাপে তিনি কিছুটা আহতও হয়েছিলেন। বহু মানুষের তার প্রতি আগ্রহ একেবারেই স্পষ্ট। তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১৪ লাখ ৫০ হাজার। হিরো আলমের প্রতি মানুষের এত আগ্রহ আমাদের সহ্য না হবারই কথা, হয়ওনি সেটা। মানুষ হিরো আলমের প্রতি কেন আগ্রহী এটারও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এফডিসি’র এক ‘ভদ্রলোক’ পরিচালক। তার মতে হিরো আলম ‘বানর’, যেহেতু তিনি খেলা দেখাবেন, তাই তার পেছনে এত মানুষ ঘোরে। এটা শুধু একজন পরিচালক বলেছেন- ব্যাপারটা এমন নয়। হিরো আলমকে নিয়ে কোনো সংবাদের ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য পড়লে দেখা যায় তাকে এভাবে দেখি আমরা অসংখ্য মানুষ। তাকে বানর বলা নিয়ে এক ফেসবুক লাইভে এসে হিরো আলম অত্যন্ত আবেগাপ্লুত হন, কাঁদেন।
মূলধারার টিভি চ্যানেলের ফেসবুক পেইজ থেকে সেটি শেয়ার করা হলে আমি দেখেছি তাতে সব রিঅ্যাকশনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ব্যঙ্গাত্মক (হা হা) রিঅ্যাকশন। আছে নানা রকম ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য। সিনেমার, মিডিয়ার জগৎটা ভীষণ রঙিন, অন্তত বাইরে থেকে সেটা মনে হয়। সেই রঙিন জগৎ অনেককেই হাতছানি দিয়ে ডাকে, অনেকেই হয়ে ওঠে মন্ত্রমুগ্ধ। জীবনে অনেক বড় অনিশ্চয়তা তৈরি করে, ভীষণ বড় বাজি ধরে এই জগতে জায়গা করার চেষ্টার অনেক গল্প আমরা জানি। হিরো আলমের মতো আর্থসামাজিক অবস্থার, দৈহিক গঠনের একজন মানুষ এমন স্বপ্ন দেখবেন আর সেটা অর্জন করার জন্য লড়াই করবেন- এটা হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। যেহেতু মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছেন তিনি, তাই নানাভাবে চেয়েছেন নিজের প্রতি মানুষের মনোযোগ ধরে রাখতে। তাই বিখ্যাত ট্রেন্ডিং সব গান তিনি গেয়েছেন। শুধু বাংলা ভাষায়ই না, গেয়েছেন আরও অনেক ভাষায়। তার গান কেমন হয়, সুর-তাল-লয় কতোটা ঠিক হয় সেটা আরেক আলোচনা। কিন্তু তিনি ‘মহাপাপ’ করে ফেললেন বেসুরো কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে। ‘রবীন্দ্র- মৌলবাদী’রা হৈ হৈ করে উঠেছিলেন সঙ্গে সঙ্গেই। হিরো আলমের সিনেমা/অভিনয় আমার ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি তার কোনো গানও। যেমন ভালো লাগেনি বহু ভদ্রলোক/সুশীল পরিচালকের সিনেমা কিংবা সংগীত শিল্পীর গান।
হিরো আলমের সিনেমা কিংবা গান যাদের ভালো লাগে তারা দেখুক, শুনুক। সমাজে এই স্পেইসটুকু লাগবেই। এটুকু না হলে তো এই সমাজ একেবারেই অসুস্থ। এক ভদ্রলোক পরিচালকের দৃষ্টিতে হিরো আলম ‘বানর’। কিন্তু আমার কাছে হিরো আলম ভীষণ শক্তিমান একজন মানুষ। তিনি প্রচলিত চিন্তা, প্রচলিত সব মানদণ্ডকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সমাজে নিজের জায়গা করার লড়াই করেছেন। আমরা ভদ্রলোকেরা সর্বস্ব দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি, বের করে দিতে চেয়েছি তাকে। মানুষের ব্যক্তি জীবনে রাষ্ট্র কতোটুকু ঢুকতে পারবে সেটা একটা রাষ্ট্রের টোটালিটারিয়ানিজমের পথে হাঁটার সঙ্গে সমানুপাতিক। যে রাষ্ট্র অনেক বেশি মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করে, সেই রাষ্ট্র আসলে টোটালিটারিয়ান হওয়ার পথে এগিয়ে যায়। এই যে একটা বিশেষ ধরনের চুলের কাটিংকে বখাটে কাটিং নাম দিয়ে সে রকম চুলের কাটিং না দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, অহেতুক পার্ক থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কিংবা একজন মানুষ তার মতো করে গান গাইবার ‘অপরাধে’ মুচলেকা দিতে হচ্ছে- এটা আসলে প্রমাণ করে এই রাষ্ট্র মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে অনধিকার প্রবেশ করছে।