২০০৬ সালে ফরাসি তরুণী মারিয়া ডে কার্টেনা মুসলিম হিসেবে হিজাব পরার সিদ্ধান নেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে পরের দিন সকালে। হিজাব পরে যখন তিনি ফ্রান্সের লিয়ন অঞ্চলের নিজ স্কুলে যান, তখন তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে তা খুলতে বাধ্য করে। সবাই প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থাকে যেন তিনি মাথা ঢেকে স্কুলে ঢুকতে না পারে।
কারণ ২০০৪ সালে দেশটির সরকারি স্কুল ও সরকারি অফিসে যেমন খ্রিস্টানদের ক্রস, ইহুদিদের কিপা ও মুসলিমদের স্কার্ফসসহ সব ধরনের ধর্মীয় প্রতীক নিষিদ্ধ করে।
দুই দশক পর এবার সরকারি স্কুলে ‘আবায়া’ নিষিদ্ধ হওয়ায় চরম হতাশা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন দেশটির মুসলিম নারীরা। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঘটনা মারিয়ার মতো অসংখ্য ফরাসি মুসলিম তরুণীকে পুরনো দিনের দুঃসহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ফ্রান্সের ইসলামোফোবিয়া বিরোধী সংগঠন পারসপেক্টিভস মুসলমানস-এর আইন ও নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মারিয়া ডে কার্টেনা।
ফরাসি এই তরুণীর সঙ্গে কথা হয় তুরস্কভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির।
তিনি বলেন, ‘পোশাক ও অনুশীলন নিয়ে এ ধরনের আইন ও নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তির ওপর মানসিক প্রভাব তৈরি করে। এখন স্কুলের প্রবেশপথে অল্প বয়সী মেয়েদের পোশাক খুলতে বলা হচ্ছে এবং তাদের পোশাক বা স্কার্ট সবার সামনে তুলে নিতে বলা হচ্ছে। ঠিক দুই দশক আগেও আমাকে হিজাব নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি তখন খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কারণ তখন আমি আমার প্রতি এই অবিচারের কারণ বুঝতে পারিনি। পরিবেশটি আমার জন্য খুবই অপমান ও হতাশাজনক ছিল। আমার মনে হচ্ছি, আমি নিজ দেহের একটি অংশ মুছে ফেলছি। তা আমার জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোর অন্যতম।’ এভাবে তিনি স্কুল ও কলেজের ছয়টি বছর অতিবাহিত করেন। এ সময় তাকে স্কুলের ভ্রমণসহ অন্যান্য কার্যক্রমেও অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। তাঁর মতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশাবোধ এবং সরকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি করে।
ফ্রান্সের ইসলামোফোবিয়া বিশেষজ্ঞ খাওতার নাজিব বলেন, ‘মুসলিম নারী বিশেষত তরুণীদের লক্ষ্য করেই এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে। এখানে আবায়া বা লম্বা পোশাক গৌন বিষয়। বরং মুসলিম নারীদের অন্য কিছু পরতে দেখলে তারা এসব পোশাকও নিষিদ্ধ করবে। এভাবে পোশাকের সীমাবদ্ধতা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এটি রাষ্ট্রীয় সমর্থনে ইসলামীভীতিমূলক কর্মকাণ্ডের আরেকটি উদাহরণ। কারণ তারা মুসলিমদের হয়রানিমূলক আচরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; বরং আইন পরিবর্তন করে বিশ্বকে হতবুদ্ধ করে তারা এসব কাজ অব্যাহত রেখেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ফলে ইতিমধ্যে হিজাব পরা নারীদের চাকরি পাওয়ার হার এক শতাংশের কমে নেমে এসেছে। শিগগির বিশ্ববিদ্যালয়েও পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। এখন শিক্ষার্থীদের স্কুল-কার্যক্রমে নিয়ে যাওয়া মা বা নারীদের হিজাব নিষিদ্ধ নিয়ে কথা চলছে। এ ধরনের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি তৈরি না হলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন নীতির বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে।’
অবশ্য শত বাধা-বিপত্তি ও নিষেধাজ্ঞার পরও ফরাসি মুসলিম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন অনেকে। এ বিষয়ে খাওতার নাজিব বলেন, ‘আমি ফরাসি মুসলিমদের নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী। কারণ বর্তমানে আমি মুসলিম তরুণদের মধ্যে অনেক শক্তিশালী বিষয় প্রত্যক্ষ করছি। অনেক তরুণ নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করছেন। দুই দশক আগে খুবই সামান্যসংখ্যক নারী হিজাব পরত। কিন্তু বর্তমানে অসংখ্য তরুণী মাথায় স্কার্ফ পরছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজ অনেক মানুষ ফ্রান্সের দৃশ্যমান ইসলামভীতির নিন্দা করছে। এমন দৃশ্য সব সময় দেখা যায় না। এর মূল কারণ হলো, কোনো সম্প্রদায় নিজ পরিচয়ের কারণে যত বেশি নিপীড়িত হবে, তারা তত বেশি সেই পরিচয় দাবি করবে। ঠিক তেমনি মানুষ নিজের মুসলিম পরিচয়ের কারণে যত বেশি আক্রান্ত হবে তখন মুসলিমরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে আগের চেয়ে বেশি গর্বিত হবে।’
সূত্র : আনাদোলু এজেন্সি