বাংলা সাহিত্যে তার অবদান মানুষ মনে রাখবে
‘জীবন ঘষে আগুন’ বের করে মানুষকে আলোকিত করায় ব্রতী হয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। এ কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। রূঢ়-বাস্তবতার চিত্র অঙ্কন করে মানুষের মন জয় করা এই গুণী ব্যক্তি সোমবার রাতে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। তার এ মহাপ্রয়াণে দেশের সাহিত্য অঙ্গনে বড় এক শূন্যতা সৃষ্টি হলো। কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি।
কয়েক মাস আগে তার কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে ঢাকায় এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল তাকে। সবার আশা ছিল, তিনি আবারও লেখালেখিতে সক্রিয় হবেন। কিন্তু তা আর হলো না।
হাসান আজিজুল হকের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়। তরুণ বয়সেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে তিনি মনোনিবেশ করেন শিক্ষকতায়। একইসঙ্গে লেখালেখি। বস্তুত এ-ই ছিল তার জীবন। প্রথম গল্পগ্রন্থেই তিনি উন্মোচিত করার চেষ্টা করেন প্রান্তিক মানুষ কীভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে সমাজের প্রভাবশালীদের দ্বারা। এ প্রবণতা চিরকাল সক্রিয় ছিল তার লেখায়। বস্তুত লেখালেখি ছিল তার কাছে জীবন সাধনারই অংশ। তার চিন্তাজুড়ে বিরাজ করত খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামের কথা।
সময়ের পরিবর্তনে মানুষের জীবনমানে পরিবর্তন আসে; সেই পরিবর্তনের পরও মানুষের রূঢ়-বাস্তবতার বহু চিত্র আলোচনার বাইরে থেকে যায়। সেই রূঢ়-বাস্তবতার স্বরূপ অনুসন্ধানকে যারা কর্তব্য বলে বিবেচনা করেন, হাসান আজিজুল হক ছিলেন তাদেরই একজন। এ কঠিন কাজে তিনি সফল হয়েছিলেন। অপ্রিয় কঠিনকে নিয়ে গবেষণা করতে গেলে বহু বাধার মুখে পড়তে হয়; সেসব বাধা অতিক্রম করে তিনি সফল হয়েছেন, মানুষের মন জয় করেছেন। তিনি সারা জীবন প্রান্তিক মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন।
তার লেখায় নাগরিক জীবনের প্রসঙ্গও এসেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের পাওয়া না-পাওয়া-সংকটের চিত্র অঙ্কন করেছেন। উড়ন্ত পতঙ্গের মতো মানুষ কীভাবে কঠিন-বাস্তবতার অগ্নিতে দগ্ধ হয় তাও তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছেন। বস্তুত তার শিক্ষক ও লেখকসত্তা আলাদা করা কঠিন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেও লেখা থেকে অবসর নেননি তিনি। গভীর জীবন দর্শনের স্বরূপ উদঘাটনে তিনি ব্যস্ত ছিলেন সারা জীবন। যেসব লেখকের লেখা পড়ে পাঠক উচ্চ নৈতিকতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ হয়, সেই লেখকদেরই একজন ছিলেন তিনি। তার লেখা পাঠককে এমন মূল্যবোধের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে, যা তাদের সব ধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সমষ্টির মঙ্গলে আত্মোৎসর্গে উৎসাহিত করে। গুণী এ লেখকের অবদান দেশের মানুষ বহুদিন মনে রাখবে। আমরা তার আত্মোর মাগফিরাত কামনা করি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই।