Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ আর কত পেছাবে?

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ আর কত পেছাবে?

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিল কর্তৃক ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৬৪টি দেশের মধ্যে ১৪১তম। ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবঞ্চিত’ হিসাবে চিহ্নিত বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ২০০০ সাল থেকে গত ২২ বছরে পিছিয়েছে ২৫ ধাপ এবং এ সময়ের মধ্যে কখনোই তার অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। এক্ষেত্রে তার অবস্থান চিহ্নিত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশের নিচে। এ ক্ষেত্রে ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে ৬১, ৮৬, ৯৭, ১০৪ ও ১১৩।

এর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দি ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) কর্তৃক ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গণতন্ত্র সূচকেও বাংলাদেশের নাজুক অবস্থার আরও অবনমন ঘটার চিত্র ফুটে উঠেছে। সমীক্ষাধীন ১৬৭টি দেশের মধ্যে ২০২২ সালে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ছিল ৭৩, সেখানে ২০২৩ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ৭৫-এ, যা ভারত ও শ্রীলংকার তুলনায় অনেক বেশি নিম্নবর্তী। শেষোক্ত এদেশ দুটির অবস্থান হচ্ছে যথাক্রমে ৪১ ও ৭০। আর বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে পূর্ণ গণতন্ত্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, হাইব্রিড শাসনব্যবস্থা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা-এ চার ভাগে বিভক্ত করে ইআইইউ বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে তৃতীয় ধাপের অর্থাৎ হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার আওতাধীন হিসাবে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বাংলাদেশকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার আওতাধীন দেশ বলে চিহ্নিত করার পক্ষে এবং এতৎসংক্রান্ত ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে তেমনটিই উঠে আসবে বলেও তারা ধারণা করছেন। আর স্বাধীনতা সূচকের মতো গণতান্ত্রিক সূচকের ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের গণতান্ত্রিক সূচকের ব্যাপক অবনমনের পরও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ৩৪ ধাপ পিছিয়ে এবং শ্রীলংকার তুলনায় পিছিয়ে আছে ৫ ধাপ।

এই যখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি তখন গত ৫২ বছরে এদেশ কী অর্জন করল, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে কিংবা বলা যায়, সেটি ওঠাই উচিত। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই অতি ক্ষুদ্র পরিসরে স্বাধীনতা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। স্বাধীনতার সহজসরল অর্থ হচ্ছে ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব ও তার আওতায় বহিঃহস্তক্ষেপবিহীন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। ১৯৭১ সালে অর্জিত ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব পুরোপুরিই বহাল আছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে বহিঃহস্তক্ষেপবিহীন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা প্রসঙ্গে। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট নানা প্রামাণ্য দলিল থেকে এটি ইতোমধ্যে স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে যে, ওই অভ্যুত্থানের সঙ্গে বহিঃশক্তির যোগাযোগ ছিল। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিরোধী দলগুলো নিজেরাই প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছিল যে, ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় হিসাবে কোনো বহিঃশক্তির সঙ্গে তাদের কার যোগাযোগ কত বেশি নিবিড় ও শক্তিশালী, যে প্রতিযোগিতা এখনো অব্যাহত আছে। আর আমাদের রাজনীতিকরাও প্রকাশ্যে বলতে এতটুকু লজ্জা ও দ্বিধাবোধ করেন না যে, কোন বহিঃশক্তি তাদের আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে কিংবা কোন বহিঃশক্তির কারণে তারা ক্ষমতায় যেতে পারেননি।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বহিঃশক্তির ওপর নির্ভরতার এমন আরও বহু উদাহরণ গত ৫২ বছরে এদেশে তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ পরিসর প্রয়োজন, যার জন্য উপযুক্ত স্থান এটি নয়। তবে সে আলোচনা এখানে না এনেও উল্লিখিত ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের নিজস্ব ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনার সব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার এখন আর এর পরিচালকমণ্ডলী বা তার জনগণের হাতে বহাল নেই। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের একটি ছোট্ট উদাহরণ সামনে আনা যেতে পারে। ইসরাইল কর্তৃক ১ এপ্রিল দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেট আক্রমণের ঘটনার পালটা ব্যবস্থা হিসাবে তারা (ইরান) ১৩ এপ্রিল রাতে ইসরাইলের ওপর ‘ট্রু প্রমিজ’ নামের যে ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অন্য অনেক দেশের মতোই ভারতও এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায় ১৪ এপ্রিল পূর্বাহ্নে। আর ইসলামি সম্মেলন সংস্থাভুক্ত (ওআইসি) বাংলাদেশ এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানায় ভারতের দেওয়া প্রতিক্রিয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর একই দিন অপরাহ্নে। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এ বিষয়ে ভারত তার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পর তার সঙ্গে মিল রেখে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্যই বাংলাদেশকে বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। অথচ ওআইসির সদস্য হিসাবে (বাংলাদেশ ও ইরান উভয়েই ওআইসির সদস্য) বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল তাৎক্ষণিক এবং অবশ্যই ভারতের আগে।

উল্লিখিত ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের দেওয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও দারুণ মিল রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা অবিলম্বে সংঘাত বন্ধ, সংযম অনুশীলন ও সহিংসতা থেকে সরে আসা এবং কূটনীতির পথে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি’ (এনডিটিভি, ১৪ এপ্রিল ২০২৪)। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে এবং আমরা চাই, ইরান-ইসরাইল উত্তেজনা নিরসনে যেসব রাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার কথা, তারা কার্যকর ভূমিকা নিক’ (বিডিনিউজ২৪.কম, ১৪ এপ্রিল ২০২৪)। এখন মর্যাদাবোধের জায়গা থেকে প্রশ্ন হচ্ছে, ‘যেসব রাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার কথা’-এর অর্থ কী? ওআইসি বা জাতিসংঘের সদস্য হিসাবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কি ভূমিকা নেওয়ার কিছুই নেই?

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের এই যে পিছিয়ে পড়া, এ থেকে তাহলে মুক্তির উপায় কী? একেবারে প্রথম উপায় হচ্ছে, চলমান অস্বীকারের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে এটি স্বীকার করে নেওয়া যে, এ উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে পিছিয়ে আছে। যে চেতনা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের আপামরসাধারণ স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, বর্তমান বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা-তার ছায়াটুকুও কি ধারণ করতে পেরেছে? যে স্বপ্ন পূরণের অনিবার্য ও অপরিহার্য পূর্বশর্ত ছিল সংবিধান নির্দেশিত গণতন্ত্র ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কি তা করতে পেরেছে? তাহলে স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ওই চেতনা কি কেবল ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবঞ্চিত’ ও ‘হাইব্রিড’ বা ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসনব্যবস্থার হাতেই বন্দি হয়ে থাকবে?

স্বাধীনতা সূচকে ২২ বছরে বাংলাদেশের ২৫ ধাপ নিচে নেমে যাওয়া প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে উদ্দেশ করে বলেছেন, আপনার দেশ গণতন্ত্রে কত ধাপ পিছিয়েছে? একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক, জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রী হিসাবে এটি তিনি জানতে চাইতেই পারেন। তবে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে এসব ক্ষেত্রে তার দেশের অবস্থা জানতে চাওয়ার চেয়েও অধিক জরুরি হচ্ছে, এ দেশের সব স্তরের মানুষের স্বপ্ন, প্রয়োজন ও কষ্টের কথাগুলো আগে জানতে চাওয়া। আর সেটি জানতে হলে দেশের ভেতরকার নানা মত ও পথের মানুষকে আস্থায় নিয়ে সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করাটাই হচ্ছে সর্বোত্তম করণীয়।

আবু তাহের খান : লেখক ও গবেষক

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments