দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র ‘দ্য রিপাবলিক অব আজারবাইজান’ এশিয়া ও ইউরোপের মোহনায় অবস্থিত। ‘ইউরোশিয়া’ অঞ্চলের এশীয় দেশ আজারবাইজান। ৮৬ হাজার ৬৬০ বর্গকিলোমিটারের দেশটির একদিকে রয়েছে কাস্পিয়ান সাগর আর অন্য তিন দিকে রয়েছে রাশিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, তুরস্ক ও ইরান। আজারবাইজানের ১০ কোটি জনসংখ্যার ৯৬.৯ শতাংশই মুসলিম।
হিজরি প্রথম শতকেই আজারবাইজানে ইসলামের আগমন হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর সময়ে আজারবাইজানে ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়। আজারবাইজানে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় উতবা ইবনে ফারকাদ (রা.)-এর নেতৃত্বে।
ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটে এই অঞ্চলে। এই সময় মিসর ও সিরিয়ার মুসলিম আরবরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে। ক্রমান্বয়ে ইসলাম আজারবাইজানের খ্রিস্টান ও মূর্তিপূজারি জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। মাত্র এক শতকের ব্যবধানে ইসলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে পরিণত হয়।
হিজরি পঞ্চম শতকে আজারবাইজান সেলজুকদের শাসনাধীন হয়। সেলজুক শাসনামলে এই অঞ্চলে সুফিবাদের বিস্তৃতি ঘটে। তাদের শাসনামলেই আজারবাইজানে শিয়া মতবাদের বিস্তৃতি ঘটে। সেলজুকদের পর আজারবাইজান উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আঠারো শতকের শেষভাগে প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রের শাসকদের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকলে রাশিয়া তাদের ওপর চড়াও হয়। ১৮৫৯ সালে ইমাম শামিলের পরাজয়বরণের মধ্য দিয়ে অত্র অঞ্চলে রুশ আগ্রাসন রোধের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। আজারবাইজানের পূর্ণ ভূমি রাশিয়া পুরোপুরি দখল না করলেও এই অঞ্চলের মুসলিম শাসকদের মধ্যে বিরোধ উসকে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করত। অবশেষে ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনীর সমর্থনে রাশিয়া আজারবাইজানে প্রবেশ করে। ২১ অক্টোবর ১৯২০ জনগণের মতামত উপেক্ষা করে আজারবাইজানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্তির পর রুশ সরকার আজারবাইজান থেকে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি মিটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সব ধরনের ধর্মচর্চার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। আগে আরবি বর্ণে আজারবাইজানি লেখা হলেও তার পরিবর্তে রুশ বর্ণে লেখার ফরমান জারি করা হয়। অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রুশ শাসনামলে আজারবাইজানে মসজিদের সংখ্যা দুই হাজার থেকে মাত্র ১৬-তে নেমে আসে। তবে স্বাধীনতার পর তা আবার বাড়তে থাকে। বর্তমানে আজারবাইজানে দুই হাজার মসজিদ রয়েছে।
রুশ শাসনামলে বিপুলসংখ্যক রুশ নাগরিক আজারবাইজানে বসতি স্থাপন করে, যাদের সংখ্যা একসময় ১০ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৮ অক্টোবর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে আজারবাইজান।
স্বাধীনতা লাভ করার পরও আজারবাইজানের রাষ্ট্র ও সমাজে রুশ শাসনের কালো দাগ রয়ে গেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলিম হলেও আজারবাইজান একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। দেশের বেশির ভাগ নাগরিক এখনো ধর্মবিমুখ। মুসলিম জনগণের খুব সামান্য অংশই ধর্মপরায়ণ। তবে আশার কথা হলো, তরুণ প্রজন্ম ইসলামপরায়ণ। তারা ক্রমেই ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে। বাকু রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিআরআই) এক প্রতিবেদনে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আজারবাইজানের মুসলমানের ধর্মীয় প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে; যাতে দেখানো হয়েছে, এই তিন বছরে ধর্মবিমুখতার হার ৫৯ থেকে ৪১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ধার্মিকের সংখ্যা ১৬ থেকে ২৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
একই সঙ্গে সে দেশে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি নমনীয় হচ্ছে। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় আজারবাইজানে মাত্র একটি মাদরাসা (ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) ছিল, ২০০০ সালে যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০। এর মধ্যে সরকার অনুমোদিত ৩০টি মাদরাসাও রয়েছে। বাকুতে অবস্থিত মাদরাসাটি ১৯৯২ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। সরকার এরই মধ্যে সাতটি ইসলামিক কলেজের অনুমোদন দিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে ২০২০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। সব মিলিয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে আজারবাইজানের মুসলিমরা।