দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সরকার, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচারে লিপ্ত ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। তবে এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিষদগার শুরু করেছেন তিনি। তার পরিচালিত ইস্টার্নলিংক ও লুকইস্ট নামে দু’টি পোর্টালে তিনি ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করতে উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাই কমিশনারের সাধারণ একটি সাক্ষাৎ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর করা একটি ফোনালাপকে কেন্দ্র করে নতুন গল্প ফেঁদেছেন এই বিতর্কিত সাংবাদিক। তার ইস্টার্নলিংক লিখেছে, ইমরান খানের সাথে ফোনে ১৫ মিনিট আলাপ করে শেখ হাসিনা কার্যত ভারতকে প্রত্যাখ্যান বা rebuff করলেন। আবার উস্কানি দিয়ে বলছেন, এই ‘হাসিনা চ্যালেঞ্জ’ ভারত এখন কীভাবে নেয় সেটাই প্রশ্ন।
শুধু তা-ই নয়, ইস্টার্নলিংকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইমরান খানের করমর্দনের ভুয়া ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর একবারও পাকিস্তান সফরে যাননি। কিন্তু ফটোশপে বিকৃত করা ছবিতে তিনি ইমরান খানের দপ্তরে সাক্ষাৎ করেছেন বলে দেখানো হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরণের বিকৃত ছবি প্রকাশ স্পষ্টতই ভারত ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আইনের লঙ্ঘণ।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সহানুভূতিশীল দুই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই ধরণের অপপ্রচারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিরক্ত দুই দেশের সরকারও।
সুবীর ভৌমিকের সাম্প্রতিক কর্মকান্ড প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান বলেন, ভারতের মিডিয়াতে সচরাচর বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণাটা বেশি হয়। এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে তারা। বাংলাদেশের উচিত এই ধরণের প্রচারণার বিরুদ্ধে কাউন্টার আর্গুমেন্ট তৈরি করা।
উষ্মা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, কোনো সূত্র ছাড়া বা নামকাওয়াস্তে অজ্ঞাতনামা সূত্র ব্যবহার করে, এমনকি নামে-বেনামে অস্তিত্বহীন ছদ্মনাম ব্যাবহার করে সুবীর ভৌমিক যেসব প্রকাশ করে চলছেন, তা কোনো সাংবাদিকতার পর্যায়েই পড়ে না। এসব প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচারের টেক্সটবুক এক্সাম্পল।
দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন এমন ব্যাক্তিরা বলছেন যে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কহানি হলে লাভবান বা খুশি হবে কেবল পাকিস্তানই। অতএব, দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক বিনষ্টের চেষ্টা করে সুবীর ভৌমিক কার্যত পাকিস্তানের স্বার্থেই কাজ করছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কাজ করার পুরোনো ইতিহাস আছে সুবীর ভৌমিকের। তিনি শেখ হাসিনাকে মিশরের হোসনি মোবারকের মতো একনায়ক বলেও সম্বোধন করেছিলেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে হত্যায় এসএসএফ-এর মধ্যে বিদ্রোহ হয়েছিল বলে ভুয়া গুজব ছড়িয়েছেন তিনি, যার সরাসরি প্রতিবাদ করেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সেই ধারাবাহিকতায় এবার শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন সুবীর ভৌমিক। তাঁর সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ককে নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। সঙ্গে রেখেছেন শুভ্র কান্তি গুপ্ত নামে এক সহকারিকে, যিনি ফেসবুকে সুবীর ভৌমিকের হয়ে বিভিন্ন অপপ্রচারে লিপ্ত।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভারত-বাংলাদেশ যে সম্পর্ক এটি রক্তের নদীতে গড়ে ওঠেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান কোনদিন আমরা অস্বীকার করতে পারবো না। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেকোন পরিস্থিতিতেই অনেক উচ্চতায় থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সুবীর ভৌমিক সম্পর্কে তিনি বলেন, সে তো আগেও অনেক রিপোর্ট করে ভারতকে বিব্রত করেছে।
অপরদিকে ফেসবুকে আওয়ামী লীগ নেতা মুকুল বোসকে উদ্ধৃত করে সুবীর ভৌমিক বিভিন্ন দাবি করলেও, মানবজমিনকে মুকুল বোস বলেছেন, সুবীর ভৌমিককে তিনি চেনেনই না। তার ভাষ্য, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সচেতন। কেউ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘুন ধরাতে পারবে না।
বাংলাদেশের সরকারি সূত্রগুলো বলছে, অতীতে বাংলাদেশে কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবি বিকৃত করে অনলাইনে প্রচার করলে সরকার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়েছে। ভবিষ্যতেও নেবে। দুই দেশের সম্পর্ক নষ্টের উস্কানি দেওয়া হলেও, সরকার থেকে সাথে সাথেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাজেই বাংলাদেশও আশা করে সুবীর ভৌমিকের এই আচরণের বিষয়ে ভারত সরকার থেকেও একই ধরণের ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।
এ ধরণের অপতথ্য ও ভুয়া সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে ভারতেই একাধিক আইন রয়েছে। উপমহাদেশের আইন নিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা অনুযায়ী, ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এছাড়া ৫০৫(১) ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে কোনো বক্তব্য বা গুজব প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছরের কারাদণ্ড। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভুয়া তথ্য ও খবর প্রচারের অপরাধে অসংখ্য মামলা রুজু করা হয়েছে। এছাড়া ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর হালনাগাদ করা নির্দেশিকায় ভুয়া খবর প্রচারের দায়ে সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডেশন বাতিল করার বিধান সম্প্রতি সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া দ্বিপাক্ষিকভাবে বাংলাদেশ বিষয়টি দিল্লির নজরে আনলেও এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।