পনেরো দিন আগে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তাহমিনা বেগম। ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সিজারের খরচ মিটিয়েছেন। শিশুটির নাম রাখার আগেই হানা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। জন্মের পরপরই মা-বাবার সঙ্গে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে তাহমিনার এই প্রথম সন্তানও। আকস্মিক বন্যার কারণে তাহমিনার সংসারের ১টা থালাবাটিও উদ্ধার করা যায়নি। বানের জলে ভেসে গেছে ঘরের সবকিছু। আধা ঘণ্টার মধ্যে ভেতরে টিনের চাল পর্যন্ত পানি ওঠে। তাহমিনার স্বামীসহ অন্যরা তখন জীবন বাঁচাতে মরিয়া। বানের জলে ভেসে ভেসে ১০ জনের সংসারের কেউ উঠেন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। আর কেউবা গ্রামের উঁচু বাড়িতে।
তাহমিনা তার আদরের সন্তানকে নিয়ে ভেজা কাপড়ে আশ্রয় নেন আরেকটি বাড়িতে। বৃহস্পতিবার থেকে এখন পর্যন্ত আছেন সেই কাপড়ে। এই চারদিনে শুধু মুড়ি আর পানি খেয়ে আছেন। আর কোনো খাবার জুটছে না।
সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া এই মা একটু বিশুদ্ধ পানিও পাচ্ছেন না। তাহমিনার শাশুড়ি রুপিয়া বেগম গতকাল ছাতক উপজেলার কানারুখা ইউনিয়নের উজিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্বামী ছাড়াও আমার চার ছেলে আছে। তাদের মধ্যে তিনজন বিয়ে করেছেন। তাদের সন্তানসহ মোট ১০ জনের সংসার। স্বামী ও সন্তানেরা যা কাজ পায় তাই করে। এবারের বন্যায় আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বানের জলে ভেসে গেছে আমাদের সবকিছু। দ্বিতীয় ছেলে নাসিরের স্ত্রী ১৫ দিন আগে সন্তান জন্ম দিয়েছে। বন্যার কারণে পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। একসঙ্গে থাকার উপায় নেই। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় যে কাপড় ছিল ওই কাপড়েই চারদিন ধরে আছি। পরিবারের সবারই একই অবস্থা। গায়ের কাপড় গায়ে ভিজে আবার শুকায়। কিন্তু সিজারের এই শিশুটির জন্য সমস্যা হচ্ছে বেশি।
মায়ের সঙ্গে শিশুটির শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। জ্বরের সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়াও মুড়ি আর পানি ছাড়া কোনো খাবার নেই। শিশু ও তার মাকে নিরাপদ কোথাও নেয়ার মতো নৌকাও নেই। ডাক্তারের কাছে নিতে পারছি না। ঘরের কারো কাছে টাকা নেই। তাই কাপড় কেনা যাচ্ছে না। নাসির ও তার বড় ভাই মিছবাহ পানির মধ্যে সিলেটের দিকে গেছে। যদি কোনো কাজকর্ম করে টাকা মিলে তাহলে কাপড় ও খাবার নিয়ে আসবে। না হলে এভাবেই থাকতে হবে। সুরমা নদীর তীরঘেঁষা ছাতকের উজিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলা পানির নিচে। দোতলার কয়েকটি রুমে গাদাগাদি করে গ্রামের অন্তত শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তার মধ্যে দুলাল রবি দাসের এক বাড়ির ৭ পরিবারের ৪০ জনের মতো সদস্য রয়েছেন। ১ মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৭০ বছর বয়সী মানুষও আছেন। দুলাল রবি দাস বলেন, নদীর পাড়ে বাড়ি হওয়াতে আঘাতটা বেশি পড়েছে আমাদের বাড়িতে। ৮ পরিবারের মধ্য ১টি ঘর ছাড়া বাকি ঘরের অস্তিত্ব নেই। ঘরের চাল সমান পানি।
কোথাও আশ্রয় না পেয়ে স্কুলে এসেছি। চারদিন ধরে না খেয়েই আছি। যেখানে তিনবেলা ভাত খেতাম এখন চারদিন ধরে একবেলাও ভাত খাইনি। ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। শুধু ভাত খেতে চায়। রিনা রবি দাস বলেন, চুলা জালানোর উপায় নেই। একটা পাতিলও নেই। বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। এক কাপড়ে চলে এসেছি। বাচ্চাদের কি খাওয়াবো। নিজে কি খাবো? কেউতো সাহায্য নিয়ে আসে না। কাছেই ইউপি সদস্যের দালানবাড়ি। একদিনও খোঁজ নিলো না। একইভাবে দুঃখের কথা জানালেন, বাসন্তি রবি দাস, নীল মনি রবি দাসসহ তাদের পরিবারের একাধিক লোক। গতকাল সারাদিন ছাতকের উজিরপুর, উদয়পুর, শেখকান্দি, জামুরাইল, দীঘলপুর, গোফরানপুর, ছৈদরগাঁও, বিলপারসহ আরও একাধিক গ্রাম ঘুরে দেখা যায় বেশিরভাগ এলাকার মূল সড়কের উপরে ৫ থেকে ৬ ফুট পানি। গ্রামের বাড়িঘরের টিনের চাল পর্যন্ত পানি। এছাড়া ছাতক উপজেলার সব ক’টি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামই কমবেশি পানির নিচে।
গোবিন্দগঞ্জ বাজারের কয়েকশ’ গজ দূরেই নৌকাঘাট। ঘাট থেকে নৌকাগুলো ছাতক সদরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে যাত্রী আনা-নেয়া করছে। এক্ষেত্রে নিয়মিত ভাড়ার ১০ গুণ গুনতে হচ্ছে। অসহায় মানুষরা তার পানিবন্দি স্বজনসহ বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে গলাকাটা ভাড়া মেনে নিয়েই গন্তব্য যাচ্ছেন। ঘাট থেকে নৌকায় উঠার পর চোখ যতদূর যায় সেখানে শুধু পানি আর পানি। বড় গাছগাছালির মাথা ছাড়া বাড়িঘরের অস্তিত্ব মিলে না। বেশিরভাগ বাড়ি পানির নিচে। ট্রলারে বসে কথা হয় উজিরপুরের আজমত উল্লাহর সঙ্গে। বললেন, চারদিন বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। এক বাড়ির পাকা ছাদের উপরে ৩০ জনের মতো আশ্রয় নিয়েছে। চারপাশে ৭-৮ ফুট পানি। বের হওয়ার উপায় নেই। বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলে চার্জ নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। একই গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন বলেন, এই এলাকার কোনো অভিভাবক নেই। চেয়ারম্যান নেই মেম্বারও নেই। গ্রামের মানুষ জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে আর পারছেন না।
আর দায়িত্বশীল একটা মানুষ একবেলা খাবার দিবে দূরের কথা একবার খবরও নেয়নি। মুড়ি আর পানি খেয়ে সবাই বেঁচে আছে। এখন মুড়িও নেই। এদিকে কোনো নৌকা আসে না। মানুষ মুড়ি কিনতে কীভাবে যাবে? নৌকার ভাড়া সাধ্যের বাইরে। কাজকর্ম না থাকায় পকেটে টাকাও নেই। আল্লাহ জানেন, কীভাবে বাঁচবো। তিনি বলেন, বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সবাই নিজের জীবন নিয়ে চিন্তিত। পাশেই একটি সরকারি স্কুল ও একটি মাদ্রাসা আছে। পানিতে একতলা বিশিষ্ট মাদ্রাসা ডুবে গেছে। প্রাইমারি স্কুলের দোতলায় জায়গা আছে কিন্তু স্কুলের কেয়ারটেকার অনুমতি নেই বলে কাউকে ঢুকতে দেয়নি। মানুষ মরে যাচ্ছে আর সে বলে অনুমতি নেই। পরে আমরা কয়েকজন মিলে তালা ভেঙে স্কুলে মানুষকে থাকার জায়গা দিয়েছি। জসিম উদ্দিন নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, স্কুল আর কয়েকটি বাড়ি ছাড়া কোথাও আশ্রয় নেয়ার জায়গা নেই। খাবার অভাবে আর বানের জলে ভেসে অনেক গরু-ছাগল মরে গেছে। শত শত হাঁসের খোঁজ নেই। আমরা এখন পথ চেয়ে আছি। কেউ যদি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। রাজিয়া বেগম নামের আরেক পানিবন্দি নারীর কাছে যেতেই তিনি বলেন, স্যার ও স্যার।
স্বামী সন্তান, ছেলের বউ, নাতি নাতনী মিলে ১০ জনের সংসার আমাদের। চারদিন ধরে ভাত চোখে দেখিনি। আধা কেজি মুড়ি দিয়ে ১০ জন মিলে চারদিন পার করেছি। স্যার অন্তত বাচ্চাটারে কিছু খাবার দেন। ছাতকের বাসিন্দা মিছবা উদ্দিন বলেন, আমরা খাবার চাই। কষ্ট করে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু খাবারে কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কত বেলা না খেয়ে থাকা যায়। মোবাইল বন্ধ। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পকেটে টাকা নেই। চুলা ধরানোর উপায় নেই। ছোট শিশু, বয়স্করা মুড়ি খেতে চায় না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাবারটা জরুরি। না হলে এভাবে আর বেশিদিন লড়াই করতে পারবো না। আবু সাইদ বলেন, এবারে যে বন্যা হলো এমন বন্যা তো আমার ৬০ বছরে দেখিনি বরং বাপ দাদার মুখেও গল্প শুনিনি। অবস্থা এমন হয়েছে কেউ যদি মারাও যায় তাকে কবর দেয়া যাবে না, জানাজাও পড়া যাবে না। লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে। ছাতকের বিভিন্ন এলাকার বাড়ির সামনে দিয়ে নৌকা গেলে বাড়ির সবাই ডাকতে থাকে। এই বুঝি কেউ খাবার নিয়ে এলো। না হয় নৌকা দিয়ে পার করে দিবে গন্তব্যে। ওদিকে গতকাল পর্যন্ত নৌকা ছাড়া ছাতকের সঙ্গে যোগাযোগের আর বিকল্প উপায় ছিল না। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কথা বলা যায়নি জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও।