কেয়ার করলেন না বাহার
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কি আত্মসমর্পণ করলেন? শুরু হতে না হতেই হার মানলেন? এলাকা ছাড়তে এমপিকে জোর করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই- এমন বক্তব্য দেয়ার পরই এসব প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। একজন আ.ক.ম বাহারউদ্দিন বাহারের বাহাদুরিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। কোন শক্তি বলে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে কেয়ারই করলেন না এমপি বাহার? গতকাল রোববার সাবেক সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের সঙ্গে সংলাপে বসেন বর্তমান ইসি। সংলাপ শেষে সিইসি’র বিস্ফোরক মন্তব্য গোটা দেশে এখন আলোচনার বিষয়। মূল বিষয় হলো- কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানোর অভিযোগে গত বুধবার কুমিল্লা-৬ আসনের এমপি আ.ক.ম বাহাউদ্দিন বাহারকে তার নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের চার দিন পরও এলাকা ছাড়েননি বাহাউদ্দিন বাহার।
তারই প্রতিক্রিয়ায় সিইসি’র এমন অসহায় বক্তব্য ভাবনার বিষয়। সিইসি আইনের ব্যাখ্যা দেন এভাবে- সেখানে বলা আছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনী এলাকায় থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে পারবেন না। কিন্তু কুমিল্লার সংসদ সদস্য তেমনটি করেছিলেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ জন্য আমরা ওনাকে চিঠি দিয়েছি। আমরা ওনাকে স্থান ত্যাগ করতে বলেছি।
তবে উনি এখনো স্থান ত্যাগ করেননি। এক্ষেত্রে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যকে এলাকা ছাড়া করতে জোর করার ক্ষমতা তো আমাদের নেই। আমরা ওনাকে বলতে পারি- আইনে এটা আছে, আপনি এলাকা থেকে সরে থাকেন। তাহলে নির্বাচনটা ভালো হয়। একজন সংসদ সদস্য যদি সেটাকে সম্মান না দেখান, তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না। ওনাকে চিঠি দিয়ে বলাটাই পর্যাপ্ত। সিইসি’র বক্তব্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না। কারণ একজন এমপি’র কাছে যদি তিনি হেরে যান, অসহায় আত্মসমর্পণ করেন তাহলে জাতীয় নির্বাচনে তার ভূমিকা কি হবে? তিনি সংসদ সদস্যকে জোর করে এলাকা থেকে বের করতে পারেন না ঠিক। কিন্তু তিনি তো ইচ্ছা করলে নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারেন।
এ ক্ষমতা তো তার রয়েছে। তিনি সেটা করেন নি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের চিঠি পেয়েই হাইকোর্টে গিয়েছিলেন বাহার। এ ব্যাপারে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬-এর ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নির্বাচনী প্রচারণা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বাধা নিষেধ: ১. সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিতে পারিবেন না। তবে শর্ত থাকে যে, ওই রূপ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হইলে তিনি কেবল তাঁহার ভোট প্রদানের জন্য ভোট কেন্দ্রে যাইতে পারিবেন। ২. নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনী কাজে সরকারি প্রচারযন্ত্র, সরকারি যানবাহন, অন্য কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ এবং সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীগণকে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
বিধিমালার ৩০ ধারায় বলা হয়েছে- নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখা: প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অর্থ, অস্ত্র ও পেশীশক্তি কিংবা স্থানীয় ক্ষমতা দ্বারা নির্বাচন প্রভাবিত করা যাইবে না। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে-বিধিমালার বিধান লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ: ১. কোন প্রার্থী বা তাহার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন-পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। নির্বাচন কমিশন যখন একজন এমপিকে বিধিমালা মানাতে বাধ্য করতে ব্যর্থ। যেখানে আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ সেখানে এ নির্বাচন কমিশন ভবিষ্যতে কতোটুকু সফল হবেন- এটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ওদিকে ইসির নির্দেশের পরও বাহাউদ্দিন বাহারের কুমিল্লায় অবস্থান নিয়ে বিপুল আলোচনা চলছে সেখানে।
বিশেষ করে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদে দুই প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা ইসির নির্দেশ উপেক্ষা করে এলাকায় অবস্থান ‘বাহারের বাহাদুরি’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের কথা- বাহারকে এলাকা ছাড়তে বলা সাক্কুর মুখে মানায় না আর সেটা কুমিল্লার মানুষ মেনেও নেবে না। ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সারের অভিযোগ, এমপি বাহার নির্বাচনকে নৌকার পক্ষে প্রভাবিত করতে কাজ করছেন। তিনি পেশাজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে ডেকে এনে নৌকার পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করছেন। তার কথা- বাহার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে পাত্তা না দিয়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছেন। বিগত দু’বারের মেয়র সাক্কু লড়ছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। শনিবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং সংসদ সদস্য আ. ক. ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। গণমাধ্যমকে সাক্কু বলেন, ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
সংসদ সদস্য বাহার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি এখানে থাকলে ভোট প্রভাবিত হবে, কারচুপিও হতে পারে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিফাত বলেন, বাহাউদ্দিন বাহার শুধু একজন এমপি নন, তিনি কুমিল্লার গণমানুষের অভিভাবকও। সাক্কুর মতো একজন দুর্নীতিবাজের অভিযোগে তাকে কুমিল্লা ছাড়তে হবে, এটা কুমিল্লার মানুষ মেনে নেবে না। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিটি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই প্রকাশ্যে তিনি ভোটের প্রচারে অবতীর্ণ হন। তার সংসদীয় এলাকার মধ্যে সিটি করপোরেশনও রয়েছে। দলীয় কার্যালয়ে তিনি একের পর এক কর্মিসভা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠান করে গেছেন। গত ৬ই জুন থেকে বাহারের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দফায় দফায় চিঠি দেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কু। সর্বশেষ শনিবার বিকালে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বাহারের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ আনেন।
সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করে ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করে’ মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সঙ্গে ও আদর্শ সদর উপজেলার নেতাকর্মীদের এক করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলার দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েও নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন । এরপরই গত বুধবার বাহারকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয় ইসি। কিন্তু এ নির্দেশের চার দিন পার হলেও এমপি বাহার এলাকা ত্যাগ করেন নি। এরই প্রেক্ষিতে গতকাল সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘‘ইসি’র নির্দেশনা পাওয়ার পরও একজন সংসদ সদস্য এটাকে সম্মান না করলে নির্বাচন কমিশনের তেমন কিছু করার নেই। তাকে তো আমরা জোর করে বের করে দিতে পারি না।’’