Friday, March 24, 2023
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামসমাজে দ্বিমত থাকা অস্বাভাবিক নয়

সমাজে দ্বিমত থাকা অস্বাভাবিক নয়

সময়টা এখন দুঃসহ, কঠিন, কণ্টকাকীর্ণ, পুষ্পে মোড়ানো নয়। চার দিকে অনিশ্চয়তা, অভাব, অনটন, অভিযোগ, বঞ্চনা, বৈষম্য- এসব কিছুর জন্য মানুষের দেহমন ক্লান্ত শ্রান্ত বিমর্ষ। দেশের বৃহত্তর শ্রেণী বঞ্চনার শিকার, দুঃখ বেদনা অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা যেন দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অনিশ্চয়তা যেন প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। এসব কিছুর সমাধান কারা করবেন কারো জানা নেই। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে। সমাজে দ্বিমত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, তবে সেটি উষ্মা, বিদ্বেষ, ক্লেদ, অহঙ্কার, বিভেদ, দূরত্ব সৃষ্টির কারণ না হওয়াই উচিত, সেটি কাক্সিক্ষত না হলেও এখন তা তীব্রভাবে বিরাজমান। সমাজে সঞ্চিত এ হলাহল দূর করতে সব বিবেকবান ও অগ্রসর মানুষ, তিনি রাজনীতিক হন, অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ, সমাজ বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, প্রযুক্তবিদ, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক হন; যে পেশায় ব্রত থাকুন না কেন, এখন ‘হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’ ‘হাতে ধরি হাত সূচী করি মন’ এই মানসিকতা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে দেশের জন্য। ৫০ বছর অতিক্রম করার পর, সম্মুখে শত বছরের জন্য রয়েছে ‘এ তুফান ভারী দিতে হবে পারি নিতে হবে তরী পার’। ঐক্যের এ কলতান তুলতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিবিদদের। সবাইকে এক সূত্রে বাঁধতে তাদের এগিয়ে আসতে হবে অতীতের ভ্রান্তির জাল ছিন্ন করেই। বলাবাহুল্য মানুষমাত্রই ভিন্ন ভিন্ন মতের অধিকারী, এটা মেনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একসাথে যতদূর যাওয়া যায়, সমন্বিত উদ্যোগের সাথী করা যায়। সে জন্য এমন উদার ধৈর্য ও সহনশীল হৃদয় নিয়ে রাজনীতিকদের মনকে আকাশের মতো বিশাল করতে হবে। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এ জনপদে বাস করে ১৭ কোটি মানুষ। যাদের অধিকাংশ হাজারো সমস্যা নিয়ে ‘অসুখী’। আজ অতীত নিয়ে কাউকে দোষারোপ করা, কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলে, বিভেদ বিদ্বেষের এ ভূখণ্ডে, তার আরো বিস্তৃতি ঘটবে। এসব ছেড়ে দিতে হবে ইতিহাসবিদদের হাতে, ইতিহাস অবশ্যই নৈর্ব্যক্তিক, যার যতটুকু পাওনা, সেখানে লিপিবদ্ধ হবে। এ নিয়ে এই মুহূর্তে হলাহল ছড়ানো বন্ধ করুন।

শুধু একটা কথাই ভাবতে হবে, এ দেশে কৃষক আর নিবেদিতপ্রাণ কৃষিবিদরা কতটুকু কী করছেন! তা ভেবে হয়তো লজ্জায় অনেকেরই মাথা হেঁট হতে পারে। আজ না হয় সেটিও দূরে সরিয়ে রেখে অনুপ্রাণিত হন, আত্মবিশ্লেষণ করুন, অগ্রগতির জন্য উদ্যোগী হন। যাদের মেধা বুদ্ধি বিবেচনাবোধ এবং সক্ষমতা রয়েছে, তাদের পেছনে দেশ-জাতির যে অবদান সে কথা ভুলবেন কেন। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ স্রষ্টা অকৃপণ হাতে অনেক দিয়েছেন, এর বিনিময়ে আমাদের জন্য কিছু করুন।

উপরে কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীদের অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ করেছি। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা সংস্থা কৃষির জন্য নিরলস কাজ করছে সেগুলোর বিষয়ে পাঠকদের অবহিত করতে সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরার চেষ্টা করব।
কৃষি খাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অনেক কিছু, যেমন- শস্য, বন, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ। আজো জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। আগের চেয়ে জিডিপিতে কৃষির অবদান কিছুটা কমলেও, প্রকৃতপক্ষে কৃষি দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে এখনো অন্যতম নিয়ামক এবং জাতির ধমনিতে প্রচুর রক্ত সঞ্চালন করছে। এখনো বিরাট জনশক্তি বৃহত্তর কৃষিতে নিয়োজিত। সর্বশেষ কৃষিশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দেশের মোট পরিবারের ৪৬ দশমিক ৬১ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ মানুষ। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা মানে জমির ওপরই নির্ভরশীলতা। এসব অবদানের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না, এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও, বাস্তবে তাই হচ্ছে। দেশে যেমন দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বাড়ছে, তেমনি কমছে আবাদযোগ্য জমি। সরকারি তথ্য অনুসারে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপর দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি, এখন দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি।

এটি কতটা আশঙ্কাজনক, যখন মানুষ বাড়ছে পক্ষান্তরে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ নিয়তই কমছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে প্রণীত দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনায় দেখা যায়, দেশে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৯০ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর, ২০২০ সালে মোট আবাদযোগ্য ৮৫ লাখ হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। কারণ আবাদযোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ভূমি ব্যবহারে বিধিবিধানের অভাব নেই। কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, এ বাস্তবতার পর যেখানে ১৯৭১ সালে দানাদার খাদ্যশস্যের উৎপাদন এক কোটি ১৮ লাখ টন ছিল; সেখানে ২০২১ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে সোয়া চার কোটি টন। ফলে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলে উঠে এসে তৃতীয় স্থানে। এ অবদানের পেছনে রয়েছে মাঠপর্যায়ে দেশের পরিশ্রমী কৃষক আর কৃষিবিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও উদ্ভাবন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলসহ আরো কিছু সংস্থার বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রম ও গবেষণা আর উদ্ভাবন। বিশেষ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অতুলনীয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিবিষয়ক একটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্বের মধ্যে প্রসিদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ও গবেষণার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। কৃষিবিজ্ঞানের সব শাখা এর আওতাভুক্ত। কৃষিসংক্রান্ত বহু কিছুর উদ্ভাবন এবং মাঠপর্যায় থেকে গবেষণাগার পর্যন্ত এর অবদান অসামান্য। পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হয়েছেন হাজারো কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানী এবং মাঠপর্যায়ে হাজার হাজার কৃষিজ্ঞান সমৃদ্ধ মাঠকর্মী। বাংলাদেশে কৃষিজ্ঞানসম্পন্ন বহু ব্যক্তি এখন বিভিন্ন কৃষিসংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিপুল জনশক্তি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে। এটা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায়। আজ বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রের যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি, এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদানটা বিরাট।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য শস্যের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। হচ্ছে বহু কিছু নিয়ে গবেষণা। পশুপালন নিয়ে বহু ধরনের টিকা-ভ্যাকসিন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার থেকে বেরিয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বৃহত্তর কৃষি খাতে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান জাতীয় অগ্রগতিতে অপরিসীম অবদান রাখছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠান সুনাম ও স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) চালের গুণমান অটুট রেখে অধিক হারে উৎপাদনের মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে ধানের জাতসহ টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করে। বিআরআরআই জন্মলগ্ন থেকে গৌরবে-সৌরভে অতিবাহিত করে এ সময়ে ৮২টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাতসহ এমন কিছু সফলতা অর্জন করেছে, যা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মানুষকে আশান্বিত করে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে এ প্রতিষ্ঠানের অর্জনগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকাও নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১. ২০০৯ থেকে ১৫ সাল পর্যন্ত দু’টি হাইব্রিডসহ খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু সর্বমোট ২৬টি ধানের জাত তৈরি করেছে। ২. দেশে চালের উৎপাদন ৩৪ দশমিক ৭০ মিলিয়ন টনে উন্নীতকরণে অবদান। ৩. বিশ্বে সর্বপ্রথম জিংকসমৃদ্ধ ধানের জাত, এন্টি অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ ধান, ডায়াবেটিক ধানের জাত উদ্ভাবন এবং ৪. প্রতি বছর ১০০ টনের অধিক ব্রিডার বীজ উৎপাদন। ৫. প্রায় এক লাখ কৃষক, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে জরুরি কৃষিসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কৃষির উন্নয়নসংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। যেমন কোর গবেষণা, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন, ধান ও ডাল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অ্যাগ্রিকালচার বায়োটেকনোলজি সাপোর্ট প্রজেক্ট, এশিয়ান ফুড সিকিউরিটি প্রকল্প, জাতীয় কৃষিপ্রযুক্তি প্রকল্প-১, প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা কার্যক্রম, কৃষিপ্রযুক্তি হস্তান্তর প্রকল্প নীতিনির্ধারণী ডকুমেন্ট ও গাইডলাইন প্রণয়ন, জমির উপযোগিতাভিত্তিক ক্রপ জোনিং ম্যাপ প্রণয়ন, সার এবং সারজাতীয় দ্রব্যের মান নির্ধারণ, ফসলের জাত ছাড়করণ, বীজ উৎপাদন ও মান নিশ্চিতকরণ, বৃহত্তর বরিশাল ও সিলেট জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ ও ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর কার্যক্রম সমন্বয়, আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, নিরাপদ ও সুষম খাবার গ্রহণে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ‘ফুডপ্লেট’ তৈরি, ডিজিটাল ডিসপ্লে কেন্দ্র স্থাপন।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। পরিকল্পনা ও সম্পদের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে জাতীয় কৃষি গবেষণাতে সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ বিএআরসির দায়িত্বে একই ছাতার নিচে দেশের সমগ্র কৃষি গবেষণা প্রয়াসের সমন্বয় সাধন। এতে যেমন কৃষি, বন ও পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা, শিল্প বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদির সমন্বিত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের ভিশন দক্ষ কার্যকর এবং টেকসই কৃষি গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এর মিশন, কৃষির উন্নয়নে উন্নত জাত ও লাগসই প্রযুক্তি এবং তথ্য উদ্ভাবনের লক্ষ্যে নার্সভুক্ত প্রতিষ্ঠান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গবেষণা সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা।

খাদ্যে পুষ্টিমান বৃদ্ধিতে আমিষের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমিষের অন্যতম উৎস মাছ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়া কালচারের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। যদিও বাংলাদেশে গরুর উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে তবুও দুধ ও গোশত উৎপাদনে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট নয়। দুধ ও গোশতের ঘাটতি যথাক্রমে ৫৭ ও ৩৭ শতাংশ অনুমিত হয়। তা ছাড়া পোলট্রি থেকে ডিমের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।

তবে সবজি উৎপাদনে দেশ স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। ফাও-এর তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ফাও এবং বারি সূত্রের বরাত দিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদন মোতাবেক, ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়ার পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম, যা ২০২১ সালে দঁড়িয়েছে ৭০ গ্রামে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে সবজি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তবে বেশ কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনে দেশ পিছিয়ে আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- গম, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ফল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন মসলা। এসবসহ অন্যান্য যেসব পণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা রয়েছে তা নিয়েও অপবাণিজ্য হয়। তাতে জনভোগান্তি চরমে পৌঁছে। মূলত বাজারব্যবস্থাপনার দুর্বলতাতেই এসব হয়ে থাকে।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, যে মান তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয়ু এবং আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আয়ু বৃদ্ধি সে লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি মাত্র উপায়। তার মতে, আয়ু বৃদ্ধি বা উৎপাদনের ওপর মানুষের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। অমর্ত্য সেন উন্নয়নের আবশ্যিক পাঁচ শর্তের কথা বলেছেন, ১. সামাজিক, ২. রাজনৈতিক, ৩. বাজারব্যবস্থা, ৪. পদ্ধতির সুযোগ এবং ৫. অসহায় শ্রেণীর সুরক্ষা। তার মতে, উন্নয়নের সমস্যাগুলো হলো-ক. অবকাঠামোর দুর্বলতা, খ. ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য, গ. বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন, ঘ. বিদেশী পণ্যের আধিপত্য, ঙ. কম সঞ্চয়, চ. আমদানিনির্ভরতা, ছ. প্রশাসনিক জটিলতা, জ. প্রতিকূল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, ঝ. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতি, ঞ. নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরগতি। যেসব বিষয় উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তার সব আমাদের দেশে বিরাজ করছে। এসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দুর্বলতার কারণে সৃষ্ট। যেসব পেশাজীবীর কথা আগে বলেছি, তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বটে; কিন্তু তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করা তথা দেশের জন্য অবদান রাখার সুযোগ খুব একটা সৃষ্টি করা হয়নি। রাজনীতিকরাই সব মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। তবে এসব কিছু করার ব্যাপারে তাদের তেমন পারঙ্গমতা নেই। তাদের ফার্স্ট বেঞ্চে বসার কথা থাকলেও বসে রয়েছেন একেবারে পেছনের বেঞ্চে। পেছনে থাকায় রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাক্সিক্ষত দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে কি না সেটি বুঝতে হবে। দায়িত্ব পালন করা নিয়ে এমন পলায়নপর মানসিকতা কখনোই ইতিবাচক হতে পারে না।

অন্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে দেশ যাতে সেবা পেতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। দেশে যাবতীয় বিষয় নিয়ে যেসব পরিকল্পনা হয়, তা বাস্তবায়নে ঢিলেমি লক্ষ করার মতো। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের এই ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে কথা বলা সাজে না বটে; কিন্তু তার জেরটা তো টানতে হয়। সে জন্য বিনয়ের সাথে বলতে চাই, দেশে তো বহু পরিকল্পনাবিদ রয়েছেন তাদের নিয়ে মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে। ওই আলোচনা থেকে নীতিনির্ধারকরা একটা বিকল্প ধারণা নিতে পারবেন। এসব একান্ত উচ্চপর্যায়ের কারিগরি বিষয় জাতীয় সংসদের বাইরে বিশেষজ্ঞদের মতই প্রণিধানযোগ্য। এমন আয়োজন অবশ্য কাউকে বড়-খাটো করার বিষয় নয় বা কারো অবমূল্যায়ন করা নয়। দেশের প্রয়োজনটা বড় করে দেখার বিষয়।

আজকে আমাদের ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতিনৈতিকতার অধঃগতি। নিঃসন্দেহে এগুলো কেবল হালের বিষয় নয়, আগেও ছিল। তবে কথা হতে পারে মাত্রার তারতম্য নিয়ে। একটি বিষয়ে দ্বিমত করা ঠিক হবে না, এসব সমাজে বিষবৃক্ষ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে এটি স্বতঃসিদ্ধ। এ থেকে মুক্ত হতে দেশের চিন্তক বোধ্যা ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে দোষ কোথায়। যারা নীতিজ্ঞানে শুধু সমৃদ্ধই নন; জীবনাচরণেও তার প্রতিভাত হয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধকে যারা ধারণ করেন, অনীতির জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন; তাদের খুঁজে বের করে সম্মুখে নিয়ে আসা দরকার। প্রয়োজনে মানুষ তো অঙ্গছেদও করে। প্রয়োজনকেই বেশি মূল্য দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতা থাকলে তা সম্ভব হবে না। অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে অনেক কিছু নিয়েই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

দেশের অগ্রগতির জন্য অনেক কিছুকেই অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হয়। এ বিষয়ে ভাবনায় সুস্থ দেহে সুস্থ মনকে যে তালিকায় রাখা খুবই জরুরি। জাতি গঠনে সুস্থ দেহমনের অধিকারীদেরই সম্মুখ ভাগে থাকতে হয়। এমন মানুষের সংখ্যা যে জনপদে বেশি, সেই জনপদ ভাগ্যবান, কেননা সেসব মানুষই সুস্থ দেহমন নিয়ে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়। যেটা হীনবল বিষণ্ন মানুষের পক্ষে টেনে নেয়া কষ্টকর। আর দেহ সুস্থ থাকলে মনটা সতেজ থাকে। সেটি সংবিধান প্রণেতাগণ যথাযথভাবে বুঝতে পেরেই তাতে মানুষের পাঁচ মৌলিক প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঁধে দিয়ে রেখেছেন। জনগণকে সুস্থ রাখতে চিকিৎসাপ্রাপ্তিকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, জনগণ কি সে সুযোগ পাচ্ছে? দেশে এখনো মাথাপিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালে শয্যার হার উল্লেখ করার মতো নয়। তাই তো দেশে এখন নানা রোগে ভারাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যে ব্যক্তি নিজের রুগ্ন দেহ নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট, তার মধ্যে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ভাবনাটা লক্ষ করা, অনুসন্ধান করা কি ঠিক। উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠার যে কথা বলা হচ্ছে, আগে তার দেহযন্ত্র মেরামত করা হলে সেখানে দুশ্চিন্তামুক্ত মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হবে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া না হলে বর্তমান সময়ে আমরা জাতি হিসেবে নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবো। তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্বের বিষয়টি কেবল বাকসর্বস্ব হলে আরো পিছিয়ে পড়তে হবে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্র গুগলে নিজের যোগ্যতাবলে কাজের সুযোগ পেয়েছেন, এটি তার একান্ত একক প্রচেষ্টার সুফল। এমন হাজারো যুবক যাতে তৈরি হয় এবং দেশকে যারা এক অপার সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেবে; সে জন্য রাষ্ট্রকে হাজার গুণ বেশি সক্রিয় হতে হবে। প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণটাই দেখি। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে কোটি কোটি ডলার আয় হয়। সে দেশ থেকে শত শত প্রযুক্তিবিদ তৈরি হচ্ছে, তারা দেশ এবং দেশের বাইরে গিয়ে তাদের মাতৃভূমির জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে। আমরা কেন চেষ্টা না করে শুধু বাগাড়ম্বর করছি। তা ছাড়া বাংলাদেশ বেশ কিছু সেক্টরের অগ্রগতির জন্য প্রশংসা পেয়েছে। আজকের দিনে তথ্যপ্রযুক্তি এমন এক জরুরি বিষয় তার জন্য কেন স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে বিলম্ব করা হচ্ছে।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments