মহানবী (সা.)-এর খেদমতে হাজির হয়ে তারা নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিতে লাগল।
এ ঘটনায় উল্লিখিত আয়াত পবিত্র কোরআনের একটি সর্বজনীন উপদেশসংবলিত আয়াত। যেখানে সংক্ষেপে ইসলামের সব বিধি-বিধান ও ন্যায়-অন্যায়ের আলোচনা করা হয়েছে। উসমান বিন মাযউন (রা.) বলেন, আমি প্রথমে চক্ষুলজ্জায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন ইসলামের সত্যতা হৃদয়ে গেঁথে গেল।
(তাফসিরে কুরতবি : ১০/১৫)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি লজ্জাহীনতা, অসংগত কাজ ও অবাধ্যতা করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)
প্রসিদ্ধ তাফসিরকার আল্লামা মুহায়ামি (রহ.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন, আল্লাহ তাআলা প্রধানত এখানে তিনটি বিষয়ে আদেশ করেছেন :
ক. ‘আদল’ তথা মধ্যমপন্থা অবলম্বন
খ. ‘ইহসান’ তথা একনিষ্ঠ ইবাদত
গ. স্বজনদের মধ্যে দান, যা উত্তম চরিত্রের সোপান।
এরপর এই তিনটি অর্জনীয় গুণের বিপরীত তিনটি বর্জনীয় স্বভাবের আলোচনা নিয়ে এসেছেন, যাতে মানুষ এসব নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে নিজেকে পবিত্র করতে পারে।
ক. ‘বেহায়াপনা’, যা মধ্যমপন্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ কাম-রিপুর বাসনা পুরা করতে গিয়ে চরমপন্থা অবলম্বন করাই বেহায়াপনা ও লজ্জাহীনতা।
খ. ‘পাপকর্ম’, যা ইহসান তথা নেক আমলের বিপরীত। কারণ নেক আমল দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ হয় এবং মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, পক্ষান্তরে পাপের কারণে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় এবং লোকসমাজে গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
গ. ‘খোদাদ্রোহিতা, যা উত্তম চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মধ্যে সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন, আত্মসাৎ, জবরদস্তি অন্তর্ভুক্ত। (তাফসিরে মুহায়েমি ১/৪১৭)
ইমাম রাজি (রহ.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে এমন তিনটি শক্তি নিহিত রেখেছেন, যা নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক।
ক. চতুষ্পদ প্রাণীদের মতো লাগামহীন কাম রিপুর শক্তি।
খ. শিকারি প্রাণীদের মতো হিংস্রতা, যারা সর্বদা অন্য প্রাণীকে শিকার করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
গ. শয়তানের মতো অবাধ্যতার শক্তি, যা মানুষকে অহমিকা আর পাপকাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে।
উল্লিখিত তিনটি শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার প্রতি এই আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাম রিপু নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘বেহায়াপনা’ থেকে বারণ করা হয়েছে। যাতে মানুষ শরিয়তবিরোধী সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। হিংস্রতা নিবারণের জন্য যাবতীয় ‘পাপকর্ম’ পরিত্যাগের আদেশ করা হয়েছে। যাতে মানুষ এমন সব আচার ব্যবহার থেকে বেঁচে থাকে, যা অন্যের জন্য পীড়াদায়ক। আর শয়তানি মনোভাব পরিহার করার জন্য ‘খোদাদ্রোহিতা’ থেকে বাঁচতে বলা হয়েছে। যাতে মানুষ অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে দূরে থাকে। (তাফসিরে রাজি : ১০/১০৭)
উল্লিখিত আয়াত থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে মানুষ তার মধ্যে গচ্ছিত আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা আর প্রতিভার অপব্যবহার যেন না করে, এটাই আল্লাহ কামনা করেন। মানবজাতির সফলতার জন্য আল্লাহ তাআলা যে বিধি-বিধান দিয়েছেন তার সীমা যাতে কিছুতেই লঙ্ঘিত না হয়, এটাই ইসলামের শিক্ষা। মানবজাতির কল্যাণ-অকল্যাণের যত দিক হতে পারে সব সংক্ষিপ্তাকারে আলোচিত হয়েছে এর মধ্যে। তাই উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) তাঁর খিলাফত আমলে সারা দেশে ফরমান পাঠিয়েছিলেন, যাতে এই আয়াত জুমার খুতবায় পাঠ করা হয়। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন হয়ে আসছে।
গোটা বিশ্বের মুসলমানরা জুমার খুতবায় এই আয়াত শোনার সুযোগ লাভ করে থাকে, যা মূলত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সর্বজনীন উপদেশ। এই উপদেশের আয়নায় নিজের জীবনকে পরখ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক। তাই যখন জুমার সম্মানিত খতিব আয়াতটি পাঠ করে শোনাবেন, তখন আমাদের কর্তব্য হবে এর মর্ম অনুধাবন করে আত্মসচেতনতা গড়ে তোলা। এতে বর্ণিত নির্দেশনা মতে আমার ব্যক্তিজীবন কতটুকু প্রস্তুত হয়েছে, কতটুকু আমল করতে পারলাম আর কী কী ত্রুটি রয়ে গেল, সেই হিসাব মেলানো।