আবু জার গিফারি (রা.)
হজরত আবু জার গিফারি (রা.)। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর একজন প্রিয় সাহাবি। আরবের প্রসিদ্ধ গিফার গোত্রে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তা ছাড়া সাহসিকতায়ও ছিলেন সবার থেকে ভিন্ন। নবীজির আগমনের আগে গিফার গোত্র ছিল পৌত্তলিক। তবে আবু জার (রা.) ছিলেন সত্যান্বেষী। আরবের মাটিতে নবীজির আগমনের কথা শুনলেন, সঙ্গে সঙ্গে সত্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। রাসুলের প্রিয় এই সাহাবির ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি ঈমানদীপ্ত ও বেশ চমকপ্রদ। রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের খবর শুনে তিনি মক্কায় উপস্থিত হন।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে নবী (সা.)-কে খোঁজ করতে লাগলেন। তিনি তাঁকে চিনতেন না। আবার কাউকে তাঁর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাও পছন্দ করলেন না। এ অবস্থায় রাত হয়ে গেল। তিনি শুয়ে পড়লেন। আলী (রা.) তাঁকে দেখে বুঝলেন যে লোকটি বিদেশি। যখন আবু জার আলী (রা.)-কে দেখলেন, তখন তিনি তাঁর পেছনে পেছনে গেলেন। কিন্তু সকাল পর্যন্ত একে অন্যকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন না। আবু জার (রা.) পুনরায় তাঁর পাথেয় ও মশক নিয়ে মসজিদে হারামের দিকে চলে গেলেন। এ দিনটি এমনিভাবে কেটে গেল, কিন্তু নবী (সা.) তাঁকে দেখতে পেলেন না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। তিনি শোয়ার জায়গায় ফিরে গেলেন। তখন আলী (রা.) তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এখনো কি মুসাফিরের গন্তব্য স্থানের সন্ধান হয়নি? সে এখনো এ জায়গায় অবস্থান করছে। তিনি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কেউ কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এ অবস্থায় তৃতীয় দিন হয়ে গেল। আলী (রা.) আগের মতো তাঁর পাশ দিয়ে যেতে লাগলেন। সঙ্গে তাঁকে নিয়ে গেলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার, তুমি কি আমাকে প্রয়োজনের কথা বলবে না? কেন তুমি এখানে এসেছ? আবু জার (রা.) বলেন, তুমি যদি আমাকে সঠিক রাস্তা দেখানোর সত্য অঙ্গীকার করো তবেই আমি তোমাকে বলতে পারি। আলী (রা.) অঙ্গীকার করলেন এবং আবু জার (রা.)-ও তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য বললেন। আলী (রা.) বলেন, তুমি যাঁর আগমনে এসেছ তিনি একজন সত্য নবী, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসুল। যখন ভোর হয়ে যাবে তখন তুমি আমার অনুসরণ করবে। তোমার জন্য ভয়ের কারণ আছে—এমন যদি কোনো ব্যাপার আমি দেখতে পাই তবে আমি রাস্তার পাশে চলে যাব যেন আমি পেশাব করতে চাই। আর যদি আমি সোজা চলতে থাকি তবে তুমিও আমার অনুসরণ করতে থাকবে এবং যে ঘরে আমি প্রবেশ করি সে ঘরে তুমিও প্রবেশ করবে। আবু জার (রা.) তাই করলেন। আলী (রা.) নবী (সা.)-এর কাছে প্রবেশ করলেন এবং তিনিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করলেন। বেশ সময় নিয়ে তিনি নবী (সা.)-এর কথাবার্তা শুনলেন এবং ওখানে বসেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে প্রথম সারির মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হলেন।
তাঁর ইসলাম গ্রহণ শেষে নবী (সা.) বলেন, তুমি তোমার স্বগোত্রে ফিরে যাও এবং আমার নির্দেশ না পৌঁছা পর্যন্ত আমার ব্যাপারে তাদের অবহিত করবে। আবু জার (রা.) বলেন, ওই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমি আমার ইসলাম গ্রহণকে মুশরিকদের সম্মুখে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করব। এই বলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ও মসজিদে হারামে হয়ে উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্তা নেই, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’ এ কথা শোনামাত্রই কাফেররা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং মারতে মারতে রক্তাক্ত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিল। এমন সময় আব্বাস (রা.) এসে তাঁকে রক্ষা করলেন এবং বলেন, তোমাদের বিপদ অবধারিত। তোমরা কি জান না, এ লোকটি গিফার গোত্রের? আর তোমাদের ব্যবসায়ী কাফেলাগুলোকে গিফার গোত্রের পাশ দিয়েই সিরিয়া যাতায়াত করতে হয়। এ কথা বলে তিনি তাদের হাত থেকে আবু জারকে রক্ষা করলেন। পরের দিন সকালে তিনি আগের মতো মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিতে লাগলেন। এ দিনেও কাফেররা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে ভীষণভাবে আঘাত করে রক্তাক্ত করে। এবারও আব্বাস (রা.) এসে তাঁকে সামলে নিলেন।
রাসুলের প্রিয় বিখ্যাত এই সাহাবি ৩২ হিজরিতে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে নশ্বর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৮৬১)