বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। কিন্তু সেই গর্ব ও অহংকার স্থায়ী হবে কি? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানুষের নানামুখী অত্যাচার সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয় তৈরি করেছে। বারবার বনে আগুন লাগছে অথবা লাগানো হচ্ছে। বনের অংশবিশেষ পুড়ে ছাই হচ্ছে।
বনভূমি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বনে মানুষের বিচরণ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বনদস্যু, গাছচোর ও চোরাশিকারিদের উৎপাত। দেদার হরিণ মারা পড়ছে। এমনকি বাঘও বাঁচতে পারে না চোরাশিকারিদের হাত থেকে। ফাঁদ পেতে, বিষ দিয়ে কিংবা গুলি করেও শিকার করা হচ্ছে। সুন্দরবনের মধ্যে থাকা নদীগুলোতে প্রায়ই কয়লা ও তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটছে। সেই সঙ্গে সুন্দরবন রক্ষা এবং এর পরিবেশ উন্নয়নে যাদের ভূমিকা রাখার কথা, তাদের অবহেলা ও অনিয়ম বনের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। এসব কারণে সুন্দরবন ক্রমেই তার জৌলুস হারাচ্ছে। তাহলে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ কী?
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে ২০১৬ সালে দুই মাসের মধ্যে পাঁচবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। আগুনের ধোঁয়া দেখে বনকর্মীরা ছুটে গেলে কিছু লোককে দৌড়ে পালাতেও দেখেন। কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের এতগুলো ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন তৎকালীন প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) ইউনুছ আলী। স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি সুন্দরবন রক্ষায় ভোলা নদী খনন, লোকালয়ের কাছাকাছি কাঁটাতারের বেষ্টনী দেওয়া, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ এবং সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন—এই চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এরপর পাঁচ বছর চলে গেছে, কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন করা হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে এবং পরেও ঘটেছে। উপযুক্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
এখানে থাকা ভোলা নদীটি প্রায় পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদীর কাছাকাছি এলাকায় অগ্নিকাণ্ডসহ বনভিত্তিক অপরাধ অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে বনের প্রাণী লোকালয়ে চলে আসছে ও মারা পড়ছে। কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত সোমবার ভোলা নদী পার হয়ে একটি চিত্রল হরিণ এবং একটি অজগর সাপ বনসংলগ্ন ধানসাগর গ্রামে চলে আসে। পরে বনরক্ষীরা সে দুটি উদ্ধার করে আবার বনে নিয়ে ছেড়ে দেন। এর আগে একটি বাঘ গত ৫ মে ধানসাগর ইউনিয়নের বনঘেঁষা টগরাবাড়ী গ্রামে চলে এসেছিল। কয়েক দিন ধরে আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। স্থানীয়রাও মনে করে, সুন্দরবন রক্ষায় ভোলা নদী দ্রুত খনন করাসহ সেই চারটি প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
সুন্দরবন ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও বিস্তৃত। সেখানে বন ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো থাকায় বনভিত্তিক পর্যটন থেকেও তারা অনেক লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ হলেও আমরা তা পারছি না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে। বনে অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।