মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং ভুয়া দাবি ছড়ানো হচ্ছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে। সংবাদমাধ্যমটি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি ভুয়া দাবি করা হচ্ছে নিচের বিষয়গুলো নিয়ে-
কমলার যোগ্যতা নিয়ে ভুয়া দাবি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্মস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন যে, তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, সে কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে ওবামা অযোগ্য; ঠিক একই রকম অভিযোগ তুলে ট্রাম্প বলেছেন, কমলা হ্যারিসও ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্য নন। ওবামাকে নিয়ে তার ওই বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের “বার্থার” বা “ওবামার জন্ম তত্ত্ব” হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। সেই দাবি পরে ভিত্তিহীন প্রমাণ হয়।
কমলা হ্যারিসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের অকল্যান্ডে। তার বাবা জ্যামাইকান এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভুত। কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করলে তিনি মার্কিন নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হন, ফলে প্রেসিডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে তার কোনো বাধা নেই।
কিন্তু গত সাত দিনে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কমালা হ্যারিস বার্থার এই শব্দগুলো ব্যবহার করে তার জন্ম নিয়ে কোনো রহস্য আছে কি-না, তা খোঁজার হিড়িক পড়ে গেছে। গুগল ট্রেন্ডে অনেকে তার জন্ম স্থান কোথায়, সে নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার এই সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের জন্ম কোথায়, তা নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে অনলাইনে মানুষ খোঁজখবর নিচ্ছে। তার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে এমন দাবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরো ছড়িয়েছে ‘কিউআনোন’ নামে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী একটি গোষ্ঠী।
এই মতাদর্শে বিশ্বাসীরা মনে করেন- সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদ মাধ্যমের উপর তলায় যেসব শিশু যৌন নিপীড়নকারী রয়েছে, তাদের ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন ট্রাম্প।
মতাদর্শ ও পরিচয় নিয়ে ভুয়া দাবি
দাবি করা হয়েছে কমলা হ্যারিস ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সাথে একাত্মতা দেখাতেন। আরো অভিযোগ করা হয়েছে যে ভাইস-প্রেসিডেন্টের মনোনয়ন গ্রহণ করার আগে পর্যন্ত তিনি কখনো কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভুত মার্কিন হিসেবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেননি।
বিবিসি অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে এটা সঠিক নয়; কারণ কমলা হ্যারিস তার দ্বৈত বংশ পরিচয় সবসময় খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেছেন। তার আত্মজীবনীতে কমলা হ্যারিস লিখেছেন, আমার মা সবসময় সচেতন ছিলেন যে তিনি দু’টি কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাকে বড় করছেন।
‘তিনি জানতেন, যে দেশকে তিনি এখন তার স্বদেশ বলে বেছে নিয়েছেন, সেই যক্তরাষ্ট্রে তাকে মায়া (তার বোন) আর আমাকে আত্মবিশ্বাসী ও গর্বিত নারী হিসেবে বড় করে তুলতে হবে। তিনি এই লক্ষ্য অর্জনে বদ্ধপরিকর ছিলেন।’
ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে লিখেছে, হ্যারিস তার ভারতীয় সংস্কৃতিকে বুকে নিয়ে বড় হয়েছেন, কিন্তু নিজেকে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে তুলে ধরে তিনি গর্ব বোধ করেন।’
বিভ্রান্তিমূলক একটি মিম ছড়ানো হয়েছে যেখানে এপি বার্তা সংস্থার দুটি খবর পাশাপাশি রেখে দেখানো হয়েছে ২০১৬ এবং ২০২০-এ সংস্থা তার পরিচয় লিখেছে দু’রকম। বিবিসি বলছে এই মিমের কারণে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
ফেসবুক আর টুইটারে এই মিম কয়েক হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে, যেটি তৈরি করা হয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বার্তা সংস্থার দুটি খবর পাশাপাশি রেখে।
একটিতে রয়েছে তাদের ২০১৬ সালের শিরোনাম, যেটিতে বলা হয়েছে কমলা হ্যারিস প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভুত সেনেটার হয়েছেন। দ্বিতীয়টি এপির সাম্প্রতিক শিরোনাম, যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার নাম ঘোষণার পর।
এতে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে মিডিয়া কমলা হ্যারিসকে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনি হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছে জো বাইডেনের রানিং মেট হিসেবে তার নাম ঘোষণার পর থেকে। অথবা বলার চেষ্টা হয়েছে যে কমলা হ্যারিস এ পর্যন্ত নিজের ভারতীয় বংশ পরিচয়ের দিকটাই তুলে ধরেছেন এবং শুধু সেই পরিচয়েই পরিচিত হতে চেয়েছেন।
কিন্তু বিবিসি কমলা হ্যারিসের আত্মজীবনীর যে উদ্ধৃতি দিয়েছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে তিনি নিজের কৃষ্ণাঙ্গ বংশ পরিচয় লুকানোর চেষ্টা করেননি।
এছাড়াও ২০১৬ সালে সেনেটে নিজের নির্বাচনের ওই খবর সংক্রান্ত এপি বার্তা সংস্থার পুরো রিপোর্টে হ্যারিসকে ভারতীয় এবং আফ্রিকান বংশোদ্ভুত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কমলা হ্যারিসকে লক্ষ্য করে আবার ‘পিৎসাগেট’ ষড়যন্ত্র
পরেরটি হলো ভুয়া ‘পিৎসাগেট ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নতুন করে ছড়ানো, যেখানে জড়ানো হয়েছে হ্যারিসের নাম। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় কয়েক হাজার লোককে বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এই অভিযোগে যে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি পিৎসা রেস্তোরাঁর মাটির নিচের একটি ঘর থেকে হিলারি ক্লিনটন এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির উর্ধ্বতন কিছু সদস্য শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনকারীদের একটি চক্র পরিচালনা করছিলেন এবং তারা এর সাথে জড়িত।
আবার সামনে এসেছে সেই পুরনো অভিযোগ। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি ইমেইল শেয়ার করে বলা হচ্ছে যে ওই ইমেলের মাধ্যমে কমলার বোন মায়াকে হিলারি ক্লিনটনের সম্মানে একটি পিৎসা পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
কিউআনোন ষড়যন্ত্র গোষ্ঠীর ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে এবং নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তাদের একটি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে এই মিথ্যা তথ্য কমলা হ্যারিস মনোনয়ন পাবার একদিন পর ফেসবুকে ছয় লাখের বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কিন্তু চরম ডানপন্থীরা ওই পিৎসা রেস্তোরাঁর ভুয়া পার্টির সাথে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম জড়িয়ে খবর ছড়ানো অব্যাহত রেখেছে।
কমলা হ্যারিসের সাথে জর্জ সোরোসকে জড়ানো
কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন পাওয়ার সঙ্গে জড়ানো হয়েছে হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভুত জনহিতৈষী ধনকুবের জর্জ সোরোসকে – যেটি আরেকটি ভিত্তিহীন তত্ত্ব।
ফেসবুকে একটি মিম কয়েক হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে কমলা হ্যারিসকে মনোনয়ন দেবার নির্দেশ দিয়েছেন জর্জ সোরোস। বারাক ওবামা এবং জো বাইডেনের পুরনো একটি ছবির ওপর সে রকমই একটি বার্তা লিখে তা-ই বলার চেষ্টা হয়েছে।
সোরোস ডেমোক্রেটিক পার্টিতে প্রচুর চাঁদা দেন। কিন্তু তাই বলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের ব্যাপারে নাক গলানোর অধিকার তাকে দেয়া হয়েছে, এমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই।
তার ছেলে কমলা হ্যারিসকে টু্ইটারে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা পোস্ট করেছেন। তার পোস্টটি ডানপন্থীরা ব্যাপকভাবে শেয়ার করেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে কমলা হ্যারিসের মনোনয়নের ব্যাপারে সোরোসের কোনো হাত আছে।
সূত্র : বিবিসি বাংলা