শুরুর গল্প
আবির তখন মাধ্যমিকের ছাত্র। অন্যের মোবাইল হাতে পেলেই বেড়ে যেত তাঁর ব্যস্ততা। ইন্টারনেটে ঢুকলে বাড়ত ভাবনার পরিধিটাও। মোবাইলের মাধ্যমে ওয়েবসাইটগুলো দেখে খুব অবাক হতেন।
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতেন আর ভাবতেন কারা বানায় এসব সাইট? কিভাবে বানায়? উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় নিজের মনের এ ধরনের প্রশ্ন থেকেই একদিন মোবাইলে সার্চ দেন ‘হাউ টু ক্রিয়েট আ ওয়েবসাইট’। সেখানে জানতে পারেন এইচটিএমএল ও সিএসএস সম্পর্কে। পরে একসময় মোবাইল দিয়ে নিজেই তৈরি করে ফেলেন আস্ত একটা ওয়েবসাইট। বিষয়টা অনেকটা গেম খেলার মতোই মনে হতো তাঁর। বললেন, ‘আমার কথাই যেন শুনে চলেছে আমার তৈরি করা ওয়েবসাইট। নিজের তৈরি ওয়েবসাইটে রেড লিখতেছি আর তা লাল হয়ে যাচ্ছে, ব্লু লিখলে নীল হচ্ছে, বিষয়টা খুবই মজা লাগত। ’
বন্ধুদের ল্যাপটপে
চাচাতো ভাই শহর থেকে বাড়ি ফিরলে তাঁর ল্যাপটপে নিজের বানানো ওয়েবসাইট খুলে দেখতেন আবির। কারণ তাঁর কোনো কম্পিউটার ছিল না। তত দিনে পার করেছেন উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি। পড়াশোনা খুব বেশি ভালো লাগেনি কখনোই। কারণ মুখস্থবিদ্যা। দেখতেন স্কুলের সবাই বাড়ি থেকে পড়া ঠোঁটস্থ করে স্কুলে এসে উগড়ে দিত। মুখস্থে তাঁর মন টানেনি, পড়তেন পরিবারের চাপে। মন পড়ে থাকত ইন্টারনেটে। তত দিনে একটি কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছেন। কিন্তু সেই সময় একটি কম্পিউটার কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না আবিরের পরিবারের। বললেন, ‘বন্ধুদের ল্যাপটপে বসে আরো বিস্তারিত শেখার চেষ্টা করতাম। তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না এগুলো করে পয়সা পাওয়া যায়। ভালো ক্যারিয়ার দাঁড় করানো যায়। নিছক ভালো লাগা থেকেই এসব নিয়ে পড়ে থাকতাম। বাবাকে যে বলব কম্পিউটার কিনে দেওয়ার কথা, আমার সেই সাহস বা বাবার সেই ধরনের সামর্থ্যও ছিল না। উপরন্তু আমার এসব কাজ আমার পরিবার পছন্দও করছিল না। তাদের ইচ্ছা ছিল ভালোভাবে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করি। ’
পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ
আর সবার মতো তাঁর বাবারও স্বপ্ন ছিল ছেলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করবে। কিংবা ডাক্তার হবে। কিন্তু পড়াশোনায় মন টেকেনি আবিরের। এসএসসি পরীক্ষায় ‘এ’ প্লাস পাননি বলে বাবা দুই দিন কথা বলেননি। রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় পরিবারের সবার মন খারাপ দেখে নিজেই তিনদিন জ্বরে পড়েছিলেন। এরপর ভর্তি হন কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। কলেজের এক বন্ধুকে সঙ্গী করে বেশির ভাগ সময় কাটাতেন ওয়েবসাইট তৈরিতে। দুজনের আড্ডার মূল বিষয়ই ছিল কিভাবে ইন্টারনেটে আরো ভালো কিছু করা যায়। কলেজ হোস্টেলে থাকতেন আবির। এখানে মোবাইল ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ। লুকিয়ে মোবাইল ব্যবহার করার কারণে শাস্তিও পেতে হয় তাঁকে। এইচএসসিতে অল্পের জন্য ‘এ’ প্লাস পাননি। পরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আর কোথাও চেষ্টাই করেননি আবির। এই সময় তাঁর জোরাজুরিতে বাবা টাকা ধার করে একটি কম্পিউটার কিনে দেন। যেন আকাশ হাতে পান আবির। পুরো সময়টা ব্যয় করতেন কম্পিউটারের পেছনেই। আরো ভালোভাবে কাজ শিখতে শুরু করেন। তবে গ্রামে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় ভীষণ ভোগান্তি পোহাতে হতো।
২০১২ সালে ঢাকায় এসে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আবির চেয়েছিলেন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়তে। কিন্তু এক নিকটাত্মীয় একই বিষয়ে পড়ে ভালো কিছু করতে ব্যর্থ হওয়ায় আবিরকে কম্পিউটার সায়েন্স পড়াতে রাজি ছিল না তাঁর পরিবার। তখন টেক্সটাইল ও ইলেকট্রিক্যালের ভালো চাহিদা। পরিবারের চাপে ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ইলেকট্রিক্যালে ভর্তি হন। প্রথম কিছু সেমিস্টার পার করতে পারলেও পরবর্তী সময়ে খুব চাপে পড়েন। কারণ সেই মুখস্থবিদ্যা।
এক পর্যায়ে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়েই হতাশায় ভুগতে শুরু করেন।
![](https://www.kalerkantho.com/ckfinder/innerfiles/images/Print%20Version%20Online/print%20/2022/08.August/07-08-2022/kalerkantho-tw-1a.jpg)
প্রথম উপাজর্ন ১০ ডলার
ঢাকায় এসে আবির প্রথম জানতে পারেন তিনি যা করেন তার মাধ্যমে টাকা উপাজর্ন করা সম্ভব। আবিরের এক বন্ধু গ্রাফিকস ডিজাইনার। একদিন তাঁর সহায়তায় একটি ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন করেন। শুরু করেন কাজ পাওয়ার চেষ্টা। প্রথম বিদেশি একজন ক্লায়েন্টের জন্য একটি লোগো ডিজাইন করেন। এই লোগো করে ১০ ডলার পান। বললেন, ‘আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে টাকাটা পাব। ওডেস্কে অ্যাকাউন্ট করে দুই বা তিন নম্বর আবেদনে কাজ পেয়ে যাই। তিন দিনের মধ্যে কাজটা করে দিই। এরপর অ্যাকাউন্টে ১০ ডলার জমা হয়। এরপর আরেকটি কাজ করে ২০ ডলার পাই। প্রথম দুই সপ্তাহে ৩০ ডলার জমা হয়। ’ সেমিস্টারের মাঝবিরতিতে বাড়িতে গিয়ে প্রথম টাকা হাতে পান। এরপর বন্ধুর অনুপ্রেরণায় পিএইচপি, এইচটিএমএল ও সিএসএস নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথম দুই বছরেই আবিরের উপার্জন ১৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়।
একসময় অফিসও নিলেন
এত দিন বন্ধু ও অন্য ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে পার্টনারশিপ ও পেমেন্টভিত্তিক কাজ করতেন। তত দিনে তাঁর মার্কেটপ্লেসেও কাজের পরিধি বেড়েছে। মার্কেটপ্লেস ‘ইনভাটো’তে প্রথম আইটেম সাবমিট করে পরের দিনই বিক্রির জন্য অনুমোদন পেয়ে গেছেন। পয়সা আসতে শুরু করেছে। কাজের পরিমাণ বাড়তে থাকায় এবার অফিস নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছিলেন না। বড় এক ভাইয়ের সঙ্গে আগে থেকেই কাজ করতেন। তাঁর সঙ্গে নিজের ভাবনা আদান-প্রদান করেন। দুজন মিলে একদিন চা খাচ্ছিলেন। তখনই আবির বলেন অফিস নেওয়ার কথা। বড় ভাই সম্মতি দেওয়ায় সেদিনই হুট করে অফিস ভাড়া নেন। সিদ্ধান্ত হয়, বড় ভাইয়ের আগেই নিবন্ধন করা ডোমেইনটিই ব্যবহার করার। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘দ্য সফট কিং’। আবির হলেন সহপ্রতিষ্ঠাতা। বললেন, ‘বড়জোর চার মাস অফিস চালানোর টাকা ছিল আমাদের কাছে। কিন্তু সহযোগী বড় ভাই সাহস দেন। বলেন, চার মাস অফিস চালিয়ে কি আরো দুই মাস অফিস চালানোর পয়সা জোগাতে পারব না? ছয় মাস পার করতে পারলেই অফিসের ভিত্তি গড়ে যাবে। ’ সেই শুরু আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আবিরকে। তবে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে। এমন দিনও গেছে যে সকাল ১০টা থেকে শুরু করে রাত ২টা পর্যন্ত কাজ করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় দেশগুলোর সময়সূচি মিলিয়ে তারপর ঘুমাতে যেতেন।
এখন জনবল ৩০
আবিরের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন ৩০ জন কর্মী। এ ছাড়া পরিচিত অনেক ছেলে-মেয়েকেই নিয়ে এসেছেন নিজের পথে। আবিরের দেখানো পথে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তাঁরাও। বললেন, ‘ভালো লাগার কাজটিকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুই নেই। এ ছাড়া আমার প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন কর্মীর কর্মসংস্থান করতে পেরেছি। এটাও অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করি। এখন প্রতিষ্ঠানটির পরিসর আরো বড় করতে চাই। আগ্রহী ছেলে-মেয়েদের শেখাতে চাই ফ্রিল্যান্সিং। যেন তারাও আমার মতো স্বাবলম্বী হতে পারে। ’
করোনাকালে একবার কঠিন সংগ্রামের সম্মুখীন হয়েছিলেন আবির। কী এক কারণে তাঁর আইডি বাতিল হয়ে যায়। মূল উপার্জন বন্ধ। একবার তো মনেও হয়েছিল গতানুগতিক চাকরিজীবনই বোধ হয় ভালো ছিল। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের বেতন পেতেন। কর্মী ও অফিস চালানোর দায় থাকত না। তবে সেই অবস্থা থেকে তিন থেকে চার মাস পরেই উতরে উঠেছেন। শুধু নিজের প্রতিষ্ঠান আর ওয়েবসাইট তৈরিই নয়, পড়াশোনাও শেষ করেছেন আবির। ইলেকট্রিক্যালের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি থেকে স্নাতকোত্তর সনদ নিয়েছেন।