কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন
‘সত্যের খাতিরে উনি ৬০ বছরের সঙ্গী স্ত্রীকেও ত্যাগ করতে পারেন’ (জয়ালক্ষ্মী)। এই জয়ালক্ষ্মী হচ্ছেন ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (১৯৯০-৯৬) টি এন সেশনের স্ত্রী। টি এন সেশন ভারতের সিইসি হিসেবে সে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তিনি মহানায়ক। অথচ বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের প্রতি দেশের মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। বিগত ১০ বছর নির্বাচন কমিশন সরকারের ইচ্ছায় যেভাবে চলেছে তাতে প্রতিষ্ঠানটির ইমেজ এখনো তলানিতে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বঙ্গভবনে সংলাপ, অতঃপর সার্চ কমিটি গঠন এবং ওই কমিটি সুশীল সমাজের মতামত নেয়ার পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট। পরদিন তারা শপথ নিয়ে প্রথম অফিস করেন ২৮ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশনের হারানো ইমেজ ফেরাতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সংলাপের উদ্যোগ নেয় কমিশন। প্রথম দফায় ১৩ মার্চ সংলাপের জন্য সুশীল সমাজের ৩০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই সংলাপে মাত্র ১৩ জন উপস্থিত হলেও ১৭ জনই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর ২২ মার্চ সংলাপের লক্ষ্যে ৪০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। যথারীতি বেশিরভাগ অতিথি সংলাপে যাননি। ৪০ আমন্ত্রিতদের মধ্যে ১৯ জন হাজির হলেও ২১ জন্য যাননি। আর যারা সংলাপে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বেশিরভাগই সরকারের নানা পর্যায়ে সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী এবং কিছু এনজিও প্রতিনিধি। পর্যায়ক্রমে সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন পেশাজীবীদের সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুই দফায় ৭০ জন বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানানোর পর তাদের বেশিরভাগ (৩৮ জন) সংলাপ বর্জন করায় শুরুতেই হোঁচট খেলেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। প্রশ্ন হচ্ছে, সংলাপে যারা অংশ নিয়ে ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ স্বার্থে মতামত দিয়েছেন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি কী সেটা করতে সাহস দেখাতে পারবেন? সংলাপে বিশিষ্টজনদের উদ্দেশ্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল স্বীকার করে বলেছেন, ‘নির্বাচনে মানুষের আস্থা ফেরাতে এবং ভোটারদের নির্বাচনমুখী করতে বিশিষ্টজনদের ভূমিকা রাখতে হবে; গণতন্ত্র সুসংহত করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক অপরিহার্য’। নতুন সিইসি এ উপলব্ধি বাস্তবধর্মী। তিনি যদি এটাই বুঝে থাকেন এবং মানেন তাহলে সংলাপে টিআইবির ‘৮ দফা প্রস্তাবনা’ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য মহৌষধ হতে পারে। সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্মজীবনে সরকারি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ সচিব ছিলেন। নির্বাচনের নামে গত ১০ বছর দেশে কি তামাশা হয়েছে তিনি তা জানেন। তিনি কী ভারতের সাবেক সিইসি টি এন সেশন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখি করার উদ্যোগ নেবেন? নাকি কাজী রকিব উদ্দিন ও কে এম নুরুল হুদার মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ের ‘অধিদপ্তর’ রূপান্তর করে রাখবেন?
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের একজন অনুগত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও প্রখ্যাত লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি ১৩ মার্চ সংলাপে অংশগ্রহণ করে নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যেন বলতে পারেন, আমি কাজটা ঠিকমতো করতে পেরেছি। নতুন সিইসি কি অধ্যাপক জাফর ইকবালের পরামর্শ গ্রহণ করবেন? নাকি যে আশঙ্কার কারণে বেশিরভাগ আমন্ত্রিত সংলাপে যাননি তাদের আশঙ্কা সঠিক প্রমাণ করবেন?
নির্বাচন কমিশন আয়োজিত ১৩ মার্চ প্রথম সংলাপে আমন্ত্রণ পাওয়া বিশিষ্টজনদের মধ্যে যারা অংশ নেননি তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী একজন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনে ফেরেশতা বসালেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাই তারা যত সংলাপ করুক বা সুন্দর প্রস্তাবই দিক, তাতে কোনো লাভ হবে না। তারা বিশিষ্টজনদের পরামর্শ কার্যকর করবেন না। সংলাপে যাওয়ার মানে অবৈধ প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়ার নামান্তর।’ প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন সংলাপের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, ‘অতীতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংলাপের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কম্পোজিশন দেখে মনে হয়েছে সংলাপে গিয়ে কোনো লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যে দৃঢ়তা, মানসিকতা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, সেটা এই কমিশনের আছে কি-না, সন্দেহ আছে। নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা যদি কমিশনের থাকে, তাহলে আমি মনে করি, ওনারা খুব ভালো করেই জানেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী করতে হবে। এই সংলাপ করা হচ্ছে লোক দেখানোর জন্য।’ সংলাপে না গেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আলাপ-আলোচনায় অনেক প্রস্তাব, পরামর্শ আসবে। ইসি যদি সে পরামর্শগুলো মেনে কাজ করেন, তাহলে সফলতা আসবে।’
ইসির দ্বিতীয় দফা সংলাপে অংশগ্রহণ করেছেন দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি টিআইবির পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে যে পরামর্শগুলো দিয়েছেন সেগুলো হচ্ছেÑ এক. যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধারাবাহিক গবেষণা ও অধিপরামর্শমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের পর্যায়ক্রমে আরো ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করে স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি কৌশল ও সুনির্দিষ্ট পথরেখা প্রণয়ন করা উচিত; খ. ইসির সাংবিধানিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও জনআস্থা অর্জনে সরকারি আনুগত্য ও প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে। গ. কমিশনের দায়িত্ব পালনে যে আইন ও বিধিমালা রয়েছে, তা পর্যাপ্ত কি-না, তা বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের প্রস্তাব করুন এবং যথাযথ অধিপরামর্শমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ঘ. নির্বাচন কমিশন এককভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে না। নির্বাচনকালীন সরকার, প্রশাসন, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনগতভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনকালে সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত করতে হবে। ঙ. নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আগ্রহী সব দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে অবাধে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। চ. বিগত নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও এমনকি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট বরাবর কমিশনের অপসারণের যে আবেদন উত্থাপিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ। ছ. জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরযোগ্য সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে ব্যাপকবিতর্কিত নির্বাচনকে ‘নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছি’Ñ এরূপ অবাস্তব দাবি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
বিশিষ্টজনরা বলেছেন, ইসির যে ইমেজ নষ্ট করেছে কাজী রকিব উদ্দিন ও কে এম নূরুল হুদা তা থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্মহ হতে হবে। তাছাড়া যারা নতুন ইসিতে কমিশনার হিসেবে রয়েছেন তাদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ বিগত দুটি নির্বাচন কমিশনে একমাত্র মাহবুব তালুকদার ছাড়া অন্য সব কমিশনার ‘জি হুজুর মার্কা’ ভূমিকা পালন করছেন।
২২ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা সংলাপে অংশ নিয়ে অতিথিদের কেউ বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তারা জাতীয় নির্বাচনে বিতর্কিত ইভিএম বাদ দেয়া, ভোটারদের বাধাহীনভাবে ভোটদানের অধিকার নিশ্চিত করা, ভোটের আগে-পরে ভোটারদের বিশেষ করে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, সংবিধান ও আইনে ইসিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োগ করতে হবে। সরকারকে খুশি করা নয় বরং নির্বাচন কমিশনকে সাহসিকতা দেখাতে হবে। কমিশন যদি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আইন ও সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, তাহলে তারা সরকারকে প্রস্তাব দেবে। আর যদি মনে করেন সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগের মানসিকতা রাখতে হবে।
বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দুই দফায় সংলাপ করার পর সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও বলেছেন, সংলাপে অনেকেই মতামত দেন বিগত নির্বাচনগুলোতে কিছু অনিয়মের কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এখন কেউ ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যান না। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর বিপক্ষে অনেকেই বক্তব্য দিয়েছেন। সিইসি নিজের উপলব্ধির কথা জানিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কষ্টসাধ্য কাজ। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা চেষ্টা করব। সত্য কাজ করতে সাহস থাকতে হবে। সাহসের পেছনে থাকতে হবে সততা। আমাদের হারানোর কিছু নেই। পাওয়ার কিছুও নেই। জীবনের শেষপ্রান্তে আমরা ইতিবাচক যদি কিছু করতে পারি, আপনাদের (সংলাপে অংশ নেয়া ব্যক্তি) সাজেশনের আলোকে নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায় সবার অংশগ্রহণে, সেটা একটা সফলতা হতে পারে। কাজী হাবিবুল আউয়াল টিএন সেশনের মতো ইতিহাস হতে চান নাকি কাজী রকিব উদ্দিন, কে এম নুুরুল হুদার মতো সরকারের তাঁবেদার হয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেন সেটা দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষা করছেন।