শুরুর গল্প
শুভ রহমান পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশোনা শেষে তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে টেকনিক্যাল লিড হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন গ্রাহক যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় মেসেজিং নিয়ে কাজ করেছিলেন। এরপর ২০১৭ সালে তাঁরা চার বন্ধু মিলে নিজেদের কম্পানি ‘মিসফিট লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন।
সেখানে শুরুতে তাঁরা আউটসোর্সিং ভিত্তিতে বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা নিজেদের প্রডাক্ট তৈরিতে মনোযোগ দেন। ২০১৯ সালে মিসফিটের একটি প্রডাক্ট হিসেবে তাঁরা অ্যালিস তৈরি করেন, যা পরে আলাদা একটি কম্পানিতেই রূপান্তরিত হয়।
অ্যালিস ল্যাব
ই-কমার্স থেকে শুরু করে অন্য সব ব্যবসায় গ্রাহকের সঙ্গে কমিউনিকেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানগুলোও গ্রাহকদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হটলাইন, ই-মেইল, ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদির মতো কমিউনিকেশন চ্যানেল ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত এসব চ্যানেলে যোগাযোগের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মী বা এজেন্ট নিযুক্ত থাকে, যারা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যোগাযোগের কাজটি করে। অনেক সময় গ্রাহকসংখ্যা বেড়ে গেলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেসপন্স ধীরগতি হয়ে যায়। এর প্রভাবে প্রতিষ্ঠানের বিক্রিও কমে যেতে পারে।
কমিউনিকেশনের এমন চ্যালেঞ্জ সমাধানেই কাজ করেছে মূলত অ্যালিস ল্যাব। তাঁরা এমন একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করেছেন, যেটি ব্যবহার করে যেকোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটিতে অটোমেশন (স্বয়ংক্রিয়) করে ফেলতে পারে।
প্রযুক্তিটি যেভাবে কাজ করে
অ্যালিস স্যাসভিত্তিক পরিষেবা দিয়ে থাকে। এটি ব্যবহার করে কমিউনিকেশনের সব মাধ্যম একত্র করে যোগাযোগের কাজটি করা যায়। অ্যালিস ব্যবহারে স্বয়ংক্রিয় মেসেজিংয়ের সুবিধাও রয়েছে। এতে দ্রুততম সময়ে গ্রাহককে তার মেসেজের উত্তর পাঠানো যায়। এ ব্যাপারে শুভ রহমান জানান, গ্রাহকরা যে ধরনের মেসেজ করে থাকে সেগুলোর মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ একই ধরনের। যেমন—একটি ই-কমার্সে গ্রাহকরা সচরাচর অর্ডার করার প্রক্রিয়া, ডেলিভারির মাধ্যম, পেমেন্ট প্রক্রিয়া, রিটার্ন পলিসি কিংবা কোনো পণ্যের স্টক আছে কি না ইত্যাদি বিষয় জানতে চায়। অ্যালিস ব্যবহারে এ ধরনের মেসেজের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় রিপ্লাই করা যায়। দ্রুত রিপ্লাই পেয়ে গ্রাহকের প্রয়োজন যেমন মেটে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপও কমে যায়। মেসেজের রিপ্লাই করতে বেশি সময় নিয়ে ফেললে অনেক সময় গ্রাহক অসন্তুষ্ট হয়, এমনকি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকেও বেছে নেয়। এতে কোনো ব্র্যান্ডের বিক্রির পরিমাণ কমে।
বর্তমান হালচাল
বর্তমানে শুভ রহমান অ্যালিস ল্যাবের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত। তাঁদের অফিস ঢাকার বনানীতে, যেখানে ৩৫ জন টিম মেম্বার কাজ করেন। অ্যালিসের বর্তমানে পেইড ও ফ্রি উভয় সংস্করণ রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১১২টি দেশ থেকে তাঁদের বিনা মূল্যের ভার্সনটির ব্যবহারকারী রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
আর তাঁদের সাবস্ক্রিপশন বেইসড পেইড ভার্সনের নিয়মিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪০০।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মিয়ানমার, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ইত্যাদিতে লোকাল পার্টনার নিয়োগের মাধ্যমে তাঁরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। এসব দেশের ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের স্থানীয় ভাষায় সেবা প্রদানেও কাজ করেছেন। বর্তমানে তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করছেন।
মূলত ই-কমার্স স্টোরগুলোর কথা মাথায় রেখে অ্যালিস তৈরি করা হলেও বর্তমানে ই-কমার্সের বাইরেও তাঁরা বিভিন্ন ব্যাংক, এফএমসিজি এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছেন।
বর্তমানে তাঁদের মোট ব্যবহারকারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশই বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান—এমনটাই জানিয়েছেন শুভ রহমান।
সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁরা এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগও পেয়েছেন।
দেশে স্যাস ইন্ডাস্ট্রিজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
কোনো সফটওয়্যারকে যখন একটি সেবা হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন সেটিকে ‘স্যাস—সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস’ বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিকভাবে স্যাস ইন্ডাস্ট্রির প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো। দেশেও স্যাস নিয়ে কাজ করছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্যাস ব্যবহারে ক্রেডিট কার্ড থেকে মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয় পেমেন্ট করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের পেমেন্টে সীমাবদ্ধতা থাকায় দেশের বাজারে স্যাস পণ্যের দ্রুত ব্যাবসায়িক সম্প্রসারণ বেশ চ্যালেঞ্জিং—এমনটাই বলেন শুভ রহমান। এই সমস্যা সমাধানে দেশীয় ব্যবহারকারীদের জন্য বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতি প্রদান করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশে স্যাসকে একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে উল্লেখ করে শুভ বলেন, ‘আমাদের দেশে টেকনিক্যাল সেক্টরে অনেক দক্ষ মানবসম্পদ বিদ্যমান। তাই অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে বসে একটি স্যাস প্রডাক্ট তৈরিতে অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগ লাগে। তাই এই সেক্টরে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরকরণপূর্বক সরকারি সহযোগিতা নিশ্চিত করা গেলে এই ইন্ডাস্ট্রির অনেক বড় হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ’