Monday, March 20, 2023
spot_img
Homeধর্মশিশুর পিতৃপরিচয় নির্ধারণে শরিয়তের মূলনীতি

শিশুর পিতৃপরিচয় নির্ধারণে শরিয়তের মূলনীতি

মানুষের বংশধারা রক্ষা ইসলামী শরিয়তের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটি। আর বংশধারা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো শিশুর পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করা এবং তাকে নিষ্কলুষ রাখা। কেননা বংশধারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে, অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন।

তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান। ’ (সুরা ফোরকান, আয়াত : ৫৪)

মানুষের পিতৃপরিচয় নির্ধারণে ইসলামী শরিয়ত বেশ কিছু মূলনীতি ও বিধান প্রণয়ন করেছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো।

পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ কেন? : মানুষের জন্য পরিচয় বা পিতৃপরিচয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈধ পরিচয় ইসলামী সমাজব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। ’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ১৩)

বৈধ পরিচয় সন্তানের অধিকার : মা-বাবার ওপর সন্তানের একটি অধিকার, তারা তাকে বৈধ পরিচয় দান করবে। তারা যদি অবৈধ পরিচয়ে তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসে তবে মা-বাবাই আল্লাহর কাছে সীমালঙ্ঘনকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(তারা প্রকৃত মুমিন) যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে, তবে নিজেদের স্ত্রী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীরা ব্যতীত। কেননা এতে তারা নিন্দিত হবে না। কেউ তাদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী। ’ (সুরা মুমিমুন, আয়াত : ৫-৭)

সন্তান কখন বৈধতার স্বীকৃতি পাবে? : প্রধানত নিম্নোক্ত সম্পর্কের ভিত্তিতেই ইসলাম শিশুকে পিতার বৈধ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তা হলো—

ক.   বৈধ বিয়ে : এ বিষয়ে আলেমরা একমত যে মা-বাবার বিয়ে বৈধ হলে তাদের সন্তানও বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। বিয়ের কমপক্ষে ছয় মাস পর সন্তান জন্মগ্রহণ করলে স্ত্রীর গর্ভের সন্তানের বাবা তার স্বামীই হবে।

খ.   ফাসিদ বিয়ে : ফাসিদ তথা এমন বিয়ে, যাতে বৈধ হওয়ার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়; কিন্তু আনুষঙ্গিক কারণে তাকে ফাসিদ বলা হয়, তা সম্পন্ন হওয়ার পর যদি স্বামী-স্ত্রী সহবাস করে এবং সন্তান জন্ম নেয়, সে বিয়েও বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

গ.   মালিকানাধীন দাসীর সন্তান : নিজের মালিকানাধীন দাসীর সন্তানও ব্যক্তির বৈধ সন্তান হিসেবে বিবেচিত হবে। (আতফালুন বিলা উসরিন, দিরাসাতুন মুকারানাতুন ফিল-ফিকহিল ইসলামী, পৃষ্ঠা ১৩৮-১৪২)

পিতৃপরিচয় যেভাবে প্রমাণিত হয় : ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে শিশুর পিতৃপরিচয় প্রমাণের কিছু আইনত ভিত্তি আছে। যেগুলো হচ্ছে—

১. স্বীকারোক্তি : স্বীকারোক্তি সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারণের একটি ভিত্তি। তবে স্বীকারোক্তির প্রতিফলন স্বীকারকারীর ওপর সীমাবদ্ধ থাকবে, তা অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তবে স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারিত হওয়ার জন্য কিছু শর্ত আছে। তা হলো—

ক.   স্বীকারকারী সাবালক, সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন হওয়া।

খ.   যে শিশুর পিতৃপরিচয় স্বীকার করা হচ্ছে, তার পিতৃপরিচয় পূর্ব থেকে নির্ধারিত না থাকা।

গ.   স্বীকারকারীর দাবি বাস্তবসম্মত হওয়া। যেমন পিতা দাবিকারী ব্যক্তি ও শিশুর বয়সের ব্যবধান কমপক্ষে ১০ বছর হওয়া। কেননা এর চেয়ে কম বয়সে পিতা হওয়া সম্ভব নয়।

ঘ.   স্বীকারকারী সত্যবাদী হওয়া। যেমন স্বীকারকারী ভিনদেশি হওয়া এবং তার দেশ ত্যাগের কোনো প্রমাণ না থাকলে অথবা শিশুর মা অন্যের বৈধ স্ত্রী হিসেবে মৃত্যুবরণ করলে তার দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হবে।

ঙ.   পিতৃত্ব লাভের বৈধ সূত্র উল্লেখ করা। কেননা ইসলামী শরিয়তে ব্যভিচারের মতো অবৈধ পন্থায় ব্যক্তি শিশুর পিতৃত্ব লাভ করতে পারে না।

চ.   স্বীকারকারীর জীবদ্দশায় স্বীকারোক্তি প্রকাশ পাওয়া। (নিজামুল উসরাতি ফিল ইসলাম : ৩/৩৯৫; আহকামুল আওলাদি ফিল-ইসলাম, পৃষ্ঠা ২২; হুকুকুল উসরাতি ফিল-ফিকহিল ইসলামী, পৃষ্ঠা ৩৭৯)

২. দলিল-প্রমাণ : দলিল ও প্রমাণের ভিত্তিতে সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রমাণিত হয়। তবে দলিলটিও শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। যেমন দুজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন নারীর সাক্ষ্য। তারা এই মর্মে সাক্ষী দেবে যে এই শিশু অমুক ব্যক্তির সন্তান এবং শিশুটি উল্লিখিত ব্যক্তির স্ত্রী বা দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : ইসলামী আইন গবেষকরা বলেন, সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্ধারণে আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতা নেওয়া বৈধ, তবে এসব প্রযুক্তির ওপর শতভাগ নির্ভর করা বা শুধু প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করার সুযোগ নেই। কেননা এসব প্রযুক্তি যত উন্নত ও নিখুঁতই হোক না কেন তা মানুষের হস্তক্ষেপ, অন্যায় ব্যবহার ও বিভ্রাটের সম্ভাবনার ঊর্ধ্বে নয়। মানুষ চাইলেই এসব প্রযুক্তির ফলাফলকে প্রভাবিত, এমনকি পাল্টে দিতে পারে। (প্রবন্ধ : হক্কু নাসাবিল জানিনি ফিশ-শরিয়াতিল ইসলামিয়্যাতি ওয়াল কানুনি দিরাসাতান মুকারানাতান, পৃষ্ঠা : ৫০)

৩. গণসাক্ষ্য : ফিকহে হানাফি অনুসারে, যদি কোনো শিশুর পিতৃপরিচয় নির্ধারণে এমন একদল মুমিন সাক্ষ্য দেয় মিথ্যার ওপর যাদের ঐকমত্যের ধারণা করা যায় না, তবে এমন সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রমাণিত হবে। তারা এভাবে সাক্ষ্য দেবে যে তারা শুনেছেন এই শিশুর পিতা অমুক ব্যক্তি এবং শিশুর এই পিতৃপরিচয় মানুষের ভেতর প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। (বাদায়িউস সানায়ে : ১/২৬৬-২৬৭)

৪. বিচারকের রায় : যখন ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো বিচারক যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কোনো শিশুর পিতৃপরিচয়ের ব্যাপারে রায় প্রদান করে, তবে তার মাধ্যমে আইনত শিশুর পিতৃপরিচয় চূড়ান্ত হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকরা সেই রায় মান্য করতে বাধ্য থাকবে। (মাউজুন নাসাবি ফিশ-শারিয়াতিল ইসলামিয়্যাতি, পৃষ্ঠা ১৮১-১৯৪)

পিতৃপরিচয়হীন শিশুর সঙ্গে আচরণ : যেসব শিশুর পিতৃপরিচয় জানা না যায়, তারা মায়ের পরিচয়ে বড় হবে। যদিও সামাজিক ও ধর্মীয় বিধানের ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য আছে, তবু এমন শিশুরা সামাজিক সদাচার লাভ করবে। কেননা পবিত্র কোরআনে এমন শিশুকে ‘মুমিনদের ভাই ও বন্ধু’ বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদেরকে ডাকো তাদের পিতৃ-পরিচয়ে, আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা অধিক ন্যায়সংগত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জানো, তবে তারা তোমাদের দ্বিনি ভাই এবং বন্ধু। ’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫)

সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করার শাস্তি : ইসলাম সন্তানের পিতৃপরিচয়ে জালিয়াতি করা এবং সন্তানের পরিচয় অস্বীকার করাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে মহিলা এক গোত্রের মধ্যে অন্য গোত্রের পুরুষ (এর বীর্য) মিশ্রিত করে সে যে গোত্রের নয়, তবে আল্লাহর কাছে তার কোনো মূল্য নেই। আর আল্লাহ তাআলা তাকে তাঁর জান্নাতে প্রবেশ করাবেন না। আর যে পুরুষ তার সন্তানকে অস্বীকার করে, অথচ সে তার দিকে ‘মমতার’ দৃষ্টি দিয়ে দেখে আল্লাহ তাআলা তাকে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন এবং তাকে কিয়ামতের দিন পূর্বাপর সব মানুষের সামনে লাঞ্ছিত করবেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩৪৮১)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথ দান করুন। আমিন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments