বর্তমান সময়ের কিছু ঘটনা আমাকে খুব ব্যথিত করে তুলেছে। চোখের সামনে এসব ঘটলেও কেন যেন মেনে নিতে কষ্ট হয়। ছোট থেকেই আমি শিক্ষকদের একটু আলাদা শ্রদ্ধামিশ্রিত চোখে দেখতাম। তিনি প্রাইভেট শিক্ষক, টোলের পণ্ডিত কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- যেই হোন কেন তাদের দেখলে, তাদের কথা শুনলে মনের মধ্যে একটা সম্মানবোধ কাজ করত। আমার অনেক বন্ধু, ছোটভাই শিক্ষক আছেন- তাদের প্রতিও আমার শ্রদ্ধার অভাব হয়নি কখনো। এমনকি তাদের অনেককে স্যার সম্বোধনও করি।
কিন্তু আজ আশপাশে হচ্ছেটা কী? বড় বড় শিক্ষালয়ের শিক্ষক, অধ্যক্ষ- যাদের দেখলে আগে শিক্ষার্থীসহ সবাই রাস্তা থেকেই সড়ে দাঁড়াত। অথচ আজ তাদের দিকে আঙুল তুলছে- এমন ভাষায় কথা বলছে; যা মুখে উচ্চারণ করাই যায় না। তবে শিক্ষার্থীরাই খারাপ হয়ে গেল, নাকি শিক্ষক-পণ্ডিতরা আজ তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত? বারবার এমন প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে।
আজ পুরনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। হয়তো সেটা বিশেষ কোনো কাজের না, তবুও সেই স্মৃতিগুলো এতদিন কিভাবে মনের মণিকোঠায় তোলা ছিল- তা ভাবতেই অবাক লাগছে।
দিন-তারিখ মনে নেই। তখন সম্ভবত ১৯৮৩ সাল। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। আমার এক বন্ধুর কাকা ছিলেন ওই সময়কার জেলা পর্যায়ের মস্তবড় কর্মকর্তা (নাম বলতে চাচ্ছি না; নাম বললে অনেকে মাইন্ড করেন)। তখনো মহাকুমা ব্যবস্থা প্রচলন ছিল; ফলে জেলা পর্যায়ের মস্ত বড় কর্মকর্তার মূল্যায়ন একটু বেশিই হতো। উনি আসলে উনার বাড়ি আশেপাশে পুলিশের টহল জোরদার করা হতো।
যাই হোক, ওই কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক মধুর ছিল। অনেক গল্প বলতেন। বাজারে নিয়ে মিষ্টিও খাওয়াতেন। তো একদিন বাজারে যাওয়ার সময় রাস্তা দিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে আসা শতচ্ছিন্ন ধুতি ও ফতুয়া পরা এক কোমর বেঁকে যাওয়া এক বৃদ্ধকে দেখে তিনি পালানোর উপক্রম করলেন; এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
বৃদ্ধটি সামনে আসতেই চারদিকে সব মানুষকে অবাক করে দিয়ে সেই জেলা পর্যায়ের বড় কর্তা, যার কাছে বড় বড় সব কলেজের অধ্যক্ষরা ধর্না দেন- তিনিই পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন আশপাশের সব মানুষ; কিন্তু বৃদ্ধটির চোখে কিংবা কথায় কোনো ভাবান্তর দেখতে পাইনি- যেন এমনটিই হওয়ার ছিল। বৃদ্ধটি শুধু ভাঙা ভাঙা জানতে চাইলেন- কে তুমি বাবা?
আমার সেই বন্ধুর বড়কর্তা কাকা বললেন- আমি অমুক। আমি আপনার কাছ থেকে ‘প্রথম শিখতে শিখেছি’। কিভাবে ‘অ’ লিখতে হয়; বলতে হয়, চলতে হয় সব আপনারই দান। আপনিই আমার ‘প্রথম গুরু’। স্মিতহাস্যে বৃদ্ধটি শুধু বললেন- শিক্ষাটি বিফলে যায়নি। ‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’। আর এটাই হবে আমার ‘গুরুদক্ষিণা’। ওই বৃদ্ধের অসহায় অবস্থা দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুর সেই কাকা; কিন্তু তিনি অতি সম্মানের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
আমার সেই বন্ধুর বড়কর্তা কাকা সেদিন যা করেছিলেন- তাতে তার সম্মান কোনো অংশে কমেছে কি? ওই বৃদ্ধের মধ্যেও আমি কোনো দাম্ভিকতা দেখতে পাইনি। ‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’- এই কথা মধ্য দিয়ে তিনি তার মনের যত কথা, যত আশীর্বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এত টুকু বোঝার অবকাশ ওই ছোট বয়সে আমার না থাকলেও এখন সব- জলবৎ তরলং।
‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’- এ কথাটির অর্থ আমার মতো অল্প বিদ্যাধরীর মাথায় না আসলেও আমাদের বড় বড় পণ্ডিত, শিক্ষক, অধ্যক্ষ, মঠাধিকারীদের মাথায় তো আসা উচিৎ। কিন্তু আজ আশপাশে যা দেখছি- তাতে খুবই ব্যথিত করে তুলছে মনকে। তা হলে কি তারা ‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’- শিক্ষাটি পাননি; নাকি স্বার্থের কাছে, লোভ-লালসার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন? যদি তাই হয়; তবে তা হবে মহা বিপজ্জনক।
কয়েক দিন আগে দেখলাম বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ- যার সম্মান সবার ওপরে তাকে তার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে লুকাতে পুলিশের সাহায্যে গোপনে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে। এর চেয়ে বড় লজ্জা জাতির আর কি হতে পারে? আমরা উচ্চশিক্ষার নামে কোথায় চলেছি?
শুধু তাই নয় বর্তমানে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থির হয়ে উঠেছে। কোথাও ‘ভালো থেকো; মানুষের সম্মান অর্জন করো’- শিক্ষার পরিবেশ নেই। সবখানেই শিক্ষক-ছাত্ররা স্বার্থের দ্বন্দ্বে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে আছে। ছাত্ররা এখন খরচের হিসাব চাচ্ছে শিক্ষকদের কাছে। তাদের রীতিমতো অপমান করা হচ্ছে। এমন হলে তো শিক্ষকদের দিকেও আঙুল ওঠাতে হচ্ছে। তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ শিক্ষকদের কাছে ছাত্ররা মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পাচ্ছে কী করে?
অনেকখানে মাঠাধিকারীদের শালীনতাও প্রশ্নবিদ্ধ। বড় বড় পণ্ডিতদের কথা-কাজই তো ছাত্রদের পাথেয়। কিন্তু সেই বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিরা যা বলছেন, করছেন- তা মুখে আনতেও লজ্জা লাগে। তাহলে তারা কী শিক্ষা দেবেন জাতিকে?
না আজ আর শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ দিতে পারছি না। তারা যা শিখে এসেছেন; শিক্ষকরা তাদের যে শিক্ষা দান করেছেন- তাই তারা করছে। এতে শিক্ষা গ্রহণকারীদের দোষ কোথায়? কয়েক দিন ধরে দেখছি দেশের একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে মৃত্যুপণ করেছে শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যকে গৃহবন্দি করে তার বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তারই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী হতে পারে?
সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি- বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকের স্থান। শিক্ষকরা ছাত্রের কাছে দ্বিতীয় পিতা বা মাতাতুল্য। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকাই বিশেষ কার্যকর। তবে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের ভূমিকা ও অবস্থান সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ভর করে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তার একটি কথা আমার খুব ভালো লাগে। শুভেন্দু পুরকায়স্থ নামে ওই কর্মকর্তা লিখেছেন- ‘শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কটা শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বন্ধনে মজবুত হওয়া প্রয়োজন। একজন আদর্শ শিক্ষক তার ছাত্রের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করেন। তিনি গুরু, পিতৃতুল্য এই অনুভূতি একজন ছাত্রের ভেতরে থাকা দরকার। এই সম্পর্ক যেখানে দৃঢ়, সেখানেই শিক্ষা তথা সমাজের অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য। কোনো নিয়ম এ সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।’
কিন্তু আজ এ কী দেখছি। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কটা এখন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার বন্ধনে আবদ্ধ নেই। সেখানে স্থান করে নিচ্ছে- স্বার্থ, লোভ আর দাম্ভিকতা। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বৈরিতায় রূপ নেবে; যা শিক্ষা তথা সমাজের অগ্রগতিতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে কী আমরা অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যাচ্ছি?