হিজরি সনের ১২ মাসের প্রতিটি মাসই নানা বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। মহান আল্লাহ প্রতিটি মাসকেই অন্য মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। প্রতিটি মাসেরই ব্যতিক্রমী কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যে বৈশিষ্ট্যের কারণে তা অন্য মাসগুলোর তুলনায় অনন্য। শাওয়াল মাস হিজরি সনের দশম মাস। আরবিতে বলা হয় ‘আশ শাউওয়াল আল মুকাররম’, অর্থাৎ সম্মানিত শাওয়াল মাস। ইসলামের দৃষ্টিতে রমজান পরবর্তী এ মাসটি বিভিন্ন দিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ও বিশিষ্ট।
এক. ঈদুল ফিতর
শাওয়াল মাস ঈদের মাস। রমজানের শেষে অনাবিল খুশি-আনন্দের আসমানি বার্তা নিয়ে আকাশে হেসে ওঠে শাওয়ালের নতুন চাঁদ। হৃদয়ে হৃদয়ে দোলে পবিত্র খুশির আলোক। এ মাসের প্রথম দিনটি ঈদের দিন। মুসলমানদের প্রধান দু’টি ধর্মীয় উৎসবের একটি তথা পবিত্র ঈদুল ফিতর এ মাসের প্রথম দিনে পালিত হয়। হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিতÑ নবী সা: বলেছেন, ‘প্রতিটি সম্প্রদায়ের আনন্দের দিন রয়েছে, আর এটি (শাওয়ালের প্রথম দিন) আমাদের আনন্দের দিন।’ (বুখারি-৯৫২, মুসলিম-৮৯২)
দুই. হজ
শাওয়াল মাস হজের মাসগুলোর প্রথম মাস। শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজÑ এ তিনটি হজের মাস। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হজ (এর সময়) নির্ধারিত কয়েকটি মাস’। (সূরা বাকারা-১৯৭)
নির্ধারিত কয়েক মাসের ব্যাখ্যায় সব সাহাবি ও তাবেয়িগণ শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের কথা উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে তাবারি, কুরতুবি : সংশ্লিষ্ট আয়াত)
ইমাম ইবনে কাসির রহ. তার বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’-এ ইমাম বুখারি রহ.-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন, ইমাম বুখারি রহ. বলেছেন, ইবনে উমর রা: বলেন, নির্ধারিত কয়েক মাস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন। (ইবনে কাসির : ১/৫৫৪)
অতএব শাওয়ালের প্রথম থেকে নিয়ে জিলহজের ১০ তারিখ পর্যন্ত হজের সময়। শাওয়াল মাস হজের সময় হওয়ার অর্থ হলোÑ কেউ চাইলে শাওয়াল মাস থেকে পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে ইহরাম বাঁধতে পারে। (হিন্দিয়া)
তিন. বিশেষ ছয় রোজা
পবিত্র শাওয়াল মাসে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ছয়টি নফল রোজা রয়েছে। রাসূল সা: এ মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখতে উম্মতকে সবিশেষ উৎসাহিত করেছেন। আবু আইয়ুব আনসারি রা: বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের রোজাগুলো রাখল এরপর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন সারা বছরই রোজা রাখল।’ (সহিহ মুসলিম-১১৬৪, আবু দাউদ-২৪৩৩) মূলত হাদিস শরিফে পবিত্র কুরআনেরই একটি আয়াতের বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। সুনানে ইবনে মাজায় হাদিসটির পরবর্তী অংশে একটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। যার অর্থ হলোÑ (মহান আল্লাহ বলেছেন) ‘যে কেউ কোনো নেক আমল করবে তাকে তার ১০ গুণ বেশি সওয়াব প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল-আনআম-১৬০) সেমতে, রমজানের এক মাসের ১০ গুণ হলো ১০ মাস আর শাওয়াল মাসের ছয় দিনের ১০ গুণ হলো ৬০ দিন অর্থাৎ দুই মাস। অতএব, যে ব্যক্তি রমজানের ৩০ রোজাসহ শাওয়ালের ছয় রোজা রাখবে সে ১২ মাস তথা পূর্ণ একটি বছর রোজা রাখার সওয়াব অর্জন করবে।
তা ছাড়া দুর্বল মানুষের যেকোনো কর্তব্য পালনে ভুল-ভ্রান্তি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই পবিত্র রমজানের রোজার মতো শ্রেষ্ঠ একটি ইবাদত পালনেও নানা ধরনের অসঙ্গতি, ভ্রান্তি বা অপূর্ণতার ছাপ রয়ে যেতে পারে। সেই অপূর্ণতা বা ঘাটতির পরিপূরক হিসেবে অপরিমেয় রহমত ও বরকতের ভাণ্ডার নিয়ে হাজির হয় শাওয়ালের ছয় রোজা। রোজাদারের পুণ্য-পাল্লা ভারী করে দেয়ার ক্ষেত্রে ছয় রোজা বিশ্বস্ত সহযোগীর ভূমিকা পালন করে।
চার. বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া মোস্তাহাব
রাসূল সা: হজরত আয়েশা রা:-এর সাথে শাওয়াল মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এ মাসেই তিনি স্বামীর ঘরে আগমন করেন। আয়েশা রা: বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে শাওয়াল মাসে বিবাহ করেন, শাওয়াল মাসেই আমার সাথে মিলিত হন। রাসূল সা:-এর কোনো স্ত্রী আমার চেয়ে বেশি সম্ভোগ্য ছিলেন? বর্ণনাকারী বলেন, আয়েশা রা: তার বংশীয় মেয়েদের শাওয়ালে বিবাহ হওয়াকে ভালো মনে করতেন। (মুসলিম-১৪২৩)
প্রাচীন আরবের লোকেরা শাওয়াল মাসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে কুলক্ষণে মনে করত। আয়েশা রা: ওই হাদিসে সে অমূলক ধারণাকে খণ্ডন করেছেন। এখনো কোনো অঞ্চলের লোকেরা শাওয়াল মাসে বিবাহ করাকে কুলক্ষণে মনে করে, যা নিতান্তই অমূলক ও হাদিস পরিপন্থী। এ হাদিসের ওপর ভিত্তি করে বহু ওলামায়ে কেরাম শাওয়াল মাসে বিবাহ করা ও বাসর করাকে মুস্তাহাব বলেছেন। (শরহে নববী, সংশ্লিষ্ট হাদিস)
লেখক: শিক্ষক, কাজিপুর আল জামিয়াতুল মাদানিয়া মাদরাসা, সিরাজগঞ্জ