Monday, March 27, 2023
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করছে। স্বাধীনতার জন্য ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের শেষ প্রান্তে চূড়ান্ত বিজয়ের একদিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের পথচলা, উন্নয়ন-অগ্রগতি ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী হতে পারে, হন্তারকরা সেটা ভালো করেই জানত। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের পথচলাকে কঠিন করে তুলতে, জাতিকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতার মধ্যে নিক্ষেপ করতে সেদিন দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব বুদ্ধিজীবী সক্রিয় ও পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদেরই হত্যার টার্গেট করা হয়। দেশবরেণ্য সেসব শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবীকে হারিয়ে জাতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও দিশাহারা হয়েছিল। সদ্যস্বাধীন দেশকে এগিয়ে নিতে তাদের জ্ঞান-মেধা, অভিজ্ঞতা ও পথনির্দেশনা থেকে জাতি বঞ্চিত হয়েছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন জাতির মেধা-মনন ও চিন্তার প্রতীক। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গোবিন্দ চন্দ্র দেব, আনোয়ার পাশাসহ বিপুল সংখ্যক শিক্ষাবিদ ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বকে হারানোর ক্ষতি কখনো পূরণ হওয়ার নয়। একই সঙ্গে একথাও স্মর্তব্য, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, সে লক্ষ্য এখনো পূরণ হয়নি। একাত্তরের আগে আমরা যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের লুণ্ঠনের অভিযোগ তুলেছিলাম আজকের বাস্তবতা তার চেয়েও খারাপ। তবে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের পতাকা আমাদের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি ও অর্জন। স্বাধীনতার লক্ষ্য ও প্রত্যাশাকে ফলপ্রসূ করে তোলার দায়িত্ব দেশের সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের। বিশেষত যে মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সেই ঐক্য ও সংহতি আজ অদৃশ্যমান। জাতীয় আত্মপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পরিক্রমার সেই মাহেন্দ্রক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির মধ্যে যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য ও সংহতি পরিলক্ষিত হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেই ঐক্যবিনাশক ষড়যন্ত্রই যেন প্রভাববিস্তারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জাতিবিভক্তির চক্রান্ত জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। অথচ জাতীয় ঐক্যই হচ্ছে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অপরিহার্য পূর্বশর্ত। আজ যারা নানা অজুহাতে জাতিকে বিভক্তি ও হানাহানির মধ্যে ঠেলে দিতে চাইছে, তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেই দুর্বল করার কাজ করছে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধারা একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন থেকে আমরা যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। জাতি এখন চরম অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতার অপসংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করছে। একদিকে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা যায়নি, অন্যদিকে জনগণের জীবনযাপনও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। স্বাধীনতার পর এত বছর পেরিয়ে এসেও ভোটারবিহীন নির্বাচনের উদাহরণ প্রত্যক্ষ করছে জাতি। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা এমন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেননি, কলম ধরেননি, জীবন দেন নি। আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তার এমন দুর্ঘটনা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার না হলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই হয়তো এখনো বেঁচে থাকতেন। তাঁরা হয়তো এমন সাংঘর্ষিক ও আত্মঘাতী রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে দিতেন না। একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক বৈচিত্র ও মতপার্থক্য থাকবেই। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য ছিল। তবে তারা তাদের মেধা ও মননশীলতাকে রাজনৈতিক হানাহানি, প্রতিহিংসায় জর্জরিত হতে দেননি। আজ জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শিক্ষা, আদর্শ ও অনুপ্রেরণাকে সামনে রেখেই আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উত্তরসূরী নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক-সাংবাদিক, পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজ সব ভেদাভেদ ভুলে এখন একটি জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পথরেখা অঙ্কন করবেন, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে এই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments