Wednesday, March 22, 2023
spot_img
Homeধর্মশহরে ও গ্রামে ঈদ

শহরে ও গ্রামে ঈদ

‘ঈদ’ শব্দটি আরবি। যার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা, বারবার আগমন করা ইত্যাদি। দিনটি যেহেতু প্রতিবছর খুশি ও আনন্দবার্তা নিয়ে সমাজে আগমন করে তাই দিনটিকে ‘ঈদ’ বলা হয়। কোরআন-হাদিসের আলোকে, তাৎপর্য ও মূল্যায়ন বিবেচনার দিক থেকে ঈদ হিসাব, পুরস্কার ও আনন্দ উৎসবের দিন হিসেবে বিবেচিত হয়।

আবার আরবি ‘আ-দাহ’ শব্দ থেকে ‘ঈদ’ শব্দের উৎপত্তি হতে পারে, তখন এর অর্থ হয় অভ্যস্ত করে তোলা। অর্থাৎ আল্লাহ প্রতিবছর বান্দাহকে দয়া, করুণা ও আনন্দভোগে অভ্যস্ত করে তোলেন। তা হলো অভিবাদন, অভিনন্দন ও আতিথেয়তার চিরন্তন অভ্যাসে অভ্যস্ত করা। ঈদের দিন আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তুলতে এই দিনে রোজা রাখাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ঈদ’ শব্দটির সরল অর্থ উৎসব, ঋতু, পর্ব।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদ উদযাপিত হয় (আনুমানিক) ৩১ মার্চ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ ১ম শাওয়াল, মদিনায়। তারই ধারাবাহিকতায় মক্কা বিজয়ের পর ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়ের ঠিক ১১ দিন পর মক্কায় ঈদ পালিত হয়। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কখন ঈদ উদযাপিত হয় তার সুনির্দিষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায় না। তবে ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ঈদ উদযাপিত হয় বলে ইতিহাসের কোনো কোনো সূত্রের দাবি। তা ছিল সুলতানি আমল এবং ১৩০০-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে।

ঈদ উদযাপন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি যে চমৎকার সংস্কৃতিও—তার প্রমাণ মহানবী (সা.) এর হাদিসে আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন মদিনাবাসীর দুটি দিন ছিল; যে দিনদ্বয়ে তারা খেলাধুলা-আনন্দ-ফুর্তি করত। রাসুল (সা.) এই দিন দুটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দিল, জাহেলি যুগে আমরা দিন দুটিতে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বলেন, আল্লাহ এই দিন দুটির পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। এখানে একটি চমৎকার সৌন্দর্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তা হলো, বিনোদনের অনুঘটক সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামী বিধানের সমন্বয়। ঈদ উদযাপনে ধর্মীয় বিধান যেমন ঈদের নামাজ, তাকবির ইত্যাদি তো অপরিবর্তিত আছে, সেই সঙ্গে সংস্কৃতি হিসেবে যে দিকগুলো ইসলাম প্রবর্তন করেছে তারও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ইসলামের মূলনীতি ও মৌলিক বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে ইসলাম তাতে বাধা দেয়নি।

বাঙালি সমাজে ঈদ সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব হিসেবে সবিশেষ অবস্থান করে নিয়েছে। তবে আজকের যে ঈদ উৎসব তার ধরন-রূপ-রস-প্রকার-প্রকরণ এক শতাব্দী পূর্বে ভিন্ন ছিল। সে সময় বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষে ‘ক্রিসমাস ডে’কে সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে পরিগণিত করা হতো। এই দিনের আগে-পরে সরকারি ছুটি বরাদ্দ ছিল। এরপর দুর্গাপূজাই ছিল জাঁকালো এবং আড়ম্বরপূর্ণ উৎসব। আর্থ-সামাজিকভাবে পশ্চাদপদ মুসলানদের পক্ষে ঈদকে জাতীয় পর্যায়ের উৎসবে পরিণত করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কেননা তাদের বেশির ভাগ ছিল বিত্তহীন ও শিক্ষাবঞ্চিত।

বিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ ‘তাবাকাতুননাসিরি’র লেখক মিহাজুস সিরাজ সেকালের ঈদ উৎসব প্রসঙ্গে বলেন, ঈদ উপলক্ষে মুসলিম শাসকরা ধর্মোপদেশমূলক বক্তব্য রাখতেন এবং ইমাম নামাজ পড়াতেন। শহর-গ্রামে ঈদগাহে জামাত অনুষ্ঠিত হতো। রমজানের শুরু থেকেই ঈদের প্রস্তুতি শুরু হতো। আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) সেকালের ঈদ জামাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ঈদের জামাতে বড়রাই শামিল হতো। তাই জামাতে খুব অল্প লোকই দেখা যেত। নতুন জামাকাপড় পরিধান করে লোকেরা গান-বাজনা করত। বাড়ি বাড়ি সারা রাত ঢোলের আওয়াজ ধ্বনিত হতো। ঈদের জামাতেও লোকেরা কাছা-ধুুতি পরিধান করে যেত। নামাজের সময় কাছা খুলতেই হতো। তবে তা নামাজ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে খুলত। নামাজের কাতারে বসার পরই চুপিসারে কাছা খুলে নিত, নামাজ শেষ হওয়ার পরই তা পরিধান করে নিত। এই ধারা বিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক পর্যন্ত অনেকটা চলমান ছিল। এরপর মুসলমান সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের সামাজিক-ধর্মীয় যাবতীয় কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন হতে থাকে। সবিশেষ বাংলাসহ উপমহাদেশে ব্যাপক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কারণে একদিকে ধর্মাচারে শুদ্ধির উন্মেষ হয়, অন্যদিকে সামাজিক সংস্কার সবাইকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় লেখালেখি, প্রকাশনা, ধর্মীয় ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদির কল্যাণে এ ধরনের সামাজিক ঐক্যের অনুষ্ঠানগুলো বেশ কার্যকর হয়ে ওঠে। ফলে এখনো আমরা দেখতে পাই দুই ঈদের আগে শহরের মানুষগুলোর গ্রামে যাওয়ার কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক-নৌপথে যুদ্ধাভিযানের আদলে ঘরে ফেরার কী দৃশ্য!

বিংশ শতাব্দীর আশি-নব্বইয়ের দশকেও ঈদকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য পরিলক্ষিত হতো তা রীতিমতো অপূর্ব। ঈদের দিন ধনী-গরিব, মনিব-ভৃত্য, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি অজানা-অচেনা মানুষজনের জন্য যে আতিথেয়তার আয়োজন তা মানবতার প্রকৃত রূপকেই প্রকাশ করে। ঈদের নামাজ শেষে কবরস্থানে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের কবর জিয়ারতের সে দৃশ্য মন-জুড়ানো। দল বেঁধে শত শত অতিথির আগমনেও কখনো বিরক্তির লেশমাত্র কারো মুখে পরিদৃষ্ট হতো না, বরং অতিথির আধিক্যে আপ্লুত হতেই দেখা যেত সবাইকে।

ঈদ মুসলিম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও মুসলমানদের দরজা উন্মুক্ত থাকে। ঈদকে কেন্দ্র করে গ্রামের মেঠো পথ তার শহরে থাকা সন্তানদের ফিরে পায়। সরব হয়ে ওঠে গ্রামের আনাচ-কানাচ। সে সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আতিথেয়তায় থাকে মিষ্টান্নজাতীয় দ্রব্য। নানা প্রকার সেমাই, পুড়িং, কেক ইত্যাদি। সময়ের বিবর্তনে তাতেও আজকাল ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো; এখন মিষ্টির তালিকা সংকুচিত হয়ে ঝালের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সমধিক বলেই মনে হয়। তাই ঈদের দিনের খাবার তালিকায় দেখা যায় নুডলস, ছোলা, পোলাও-বিরিয়ানির মতো ভারী খাবার। শহরের ঈদ উদযাপন অনেকটা ভিন্ন আঙ্গিকের; সেখানে আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা কম বিধায় বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ, রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের বাসাবাড়িতে যাওয়া-আসা হয়। সেখানকার আতিথেয়তার ধরন-মাত্রাও বেশ জৌলুসপূর্ণ হয়ে থাকে।

অবশ্য আধুুুনিকতা পেরিয়ে উত্তরাধুনিকের এ কালে বেশ অশনি নিদর্শনও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। একসময় কিশোর, তরুণ-তরুণীরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য কী যে উদগ্রীব ছিল, তা আর পরিলক্ষিত হয় না। এখন কোনোমতে ঈদ জামাত শেষ করে মোবাইল কিংবা অন্য যেকোনো ডিভাইসে বুঁদ হয়ে থাকে। না আছে আত্মীয়তার সম্পর্কের অনুভূতি, না আছে তার ব্যাপারে কোনো আবেগ-আগ্রহ, বরং যান্ত্রিক বিধ্বংসী যন্ত্রটিই তার জীবন হয়ে উঠছে!

গ্রামের নিষ্কলুষ পরিবেশও আজ দেখা যায় ঈদও ঐতিহ্যশূন্য হতে চলেছে; গ্রামের টং দোকান, পুকুরঘাট, বটতলা ইত্যাদি জায়গায় দেখা যায় জটলা, হাতে তাসের সেট, সামনে জুয়ার বেটে ছড়ানো ছিটানো টাকার বান্ডিল। একইভাবে দেখা যায় ক্যারম, মার্বেল ইত্যাদির খেলা, পশ্চাতে জুয়ার মেলা! তবু ভ্রাতৃত্ব-হৃদ্যতা-সৌহার্দ্যের বার্তাবাহী ঈদ ইসলামের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধের প্রকাশের অন্যতম অনুঘটক। ঈদ সবার জীবনে বয়ে দিক খুশি-আনন্দ ও শান্তি-সুখের ফল্গুধারা।

লেখক : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments