Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামশবে-বরাতের মর্যাদা

শবে-বরাতের মর্যাদা

আছে কি কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোনো জীবিকা সন্ধানকারী, আমি তাকে জীবিকা প্রদান করব। আছে কি কোনো ব্যথিত, বিপদগ্রস্ত, আমি তাকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে নিষ্কৃতি প্রদান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত মহান দয়ালু প্রেমময় আল্লাহপাক তার বান্দাদের আহ্বান করতে থাকেন। এই রাতটির নাম হলো লাইলাতুল বারাত বা শবে-বরাত। ৪টি রাতকে আল্লাহপাক অন্যান্য রাতের তুলনায় অধিক মর্যাদা প্রদান করেছেন। এ ৪টি রাত হলো শবে-কদর, শবে-বরাত, শবে মিরাজ ও শবে ঈদ। শবে-বরাত সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, এ রাতে তাহাজ্জুদের মধ্যে রাসূলে পাক (সা.) এত দীর্ঘ সময় সেজদারত থাকলেন, আমি সন্দিহান হয়ে পড়ছিলাম যে, রাসূলে পাক (সা.) বুঝি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমি বিচলিত হয়ে তার কাছে গিয়ে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে নাড়া দিলাম, তাতে তিনি নড়ে উঠলেন। আমি নিশ্চিত হয়ে নিজ স্থানে চলে গেলাম। নামাজ শেষ করে কিছু কথা বলার পর তিনি এরশাদ করলেন, হে আয়েশা! আজ কোন রাত, তুমি কি জান? আমি বললাম, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল অধিক জানেন। তিনি বললেন, আজ শাবান মাসের ১৫তম রাত। এই রাতে আল্লাহপাক দুনিয়াবাসীকে কৃপা করেন, এ রাতে বিশ্ববাসীর তকদির সম্বন্ধীয় যাবতীয় বিষয়ের নথিপত্র কার্যকর করার উদ্দেশে ফেরেশতাদের নিকট সোপর্দ করেন। যার মধ্যে জন্ম, মৃত্যু, হায়াত, রিজিক, দৌলত, জয়-পরাজয়, সম্মান, সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন ইত্যাদি বিষয় সন্নিবেশিত থাকে।

এ রাত সম্পর্কে আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হা-মিম, ইহা সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয়ই আমি এ কিতাব (কুরআন কারীম) নাজিল করেছি এক বরকতময় রজনীতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক হিকমতপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত করা হয়।’ (সূরা দুখান, আয়াত: ১-৪)।

আবার সুরা কদরে বলা হয়েছে, আল্লাহপাক তাঁর কুরআনকে কদরের রাতে নাজিল করেছেন। এবার প্রশ্ন হতে পারে যে, এর মধ্যে কোনটি সঠিক? আসলে দুটোই সঠিক। এর অর্থ হলো, আল্লাহপাক কুরআন শবে-বরাতে লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল করেছেন এবং এখান থেকে অল্প অল্প করে অর্থাৎ প্রয়োজনানুসারে হযরত জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে রাসূলেপাক (সা.) এর কাছে নাজিল করেছেন শবে কদরে। এরপর এটিকে কার্যকর করেছেন রাসূলে পাক (সা.)।

দুটিই মুবারক বা বরকতময় রাত। তাছাড়া পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক অনেক জিনিসকেই মুবারক বলেছেন। এটি একটি বরকতময় উপদেশ (পবিত্র কুরআন) যা আমি নাজিল করেছি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৫০) পবিত্র কুরআনকে বরকতময় বলার অর্থ হলো, এই কুরআন যে পড়বে, এর প্রতি ঈমান আনবে, সে সরল-সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবে। দোজখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে। এই বরকত সন্তান-সন্ততি পর্যন্ত চলতে থাকবে।

রাসূলে পাক (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন মনোযোগের সাথে পড়বে, এর বরকতে তার মা-বাপের গুনাহ হালকা হয়ে যাবে। যদি সে কাফেরও হয়।

পানিকে আল্লাহপাক মুবারক বলেছেন। যেমন, ‘আমি আকাশ থেকে বরকতময় পানি বর্ষণ করি এবং এ দ্বারা বাগান ও শস্য উদগত’ (সূরা কাফ, আয়াত: ৯)। পানিকে বরকতময় বলার কারণ, পানির মধ্যে সবকিছুর জীবন। যেমন, আল্লাহপাক বলেছেন, ‘প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০)। পানির মধ্যে আল্লাহপাক ১০টি সূক্ষ্ম জিনিস উপহার দিয়েছেন, যেমন- ১. লজ্জাশীলতা, ২. শক্তি-সামর্থ্য, ৩. কোমলতা, ৪. পরিচ্ছন্নতা, ৫. গতি, ৬. সতেজতা, ৭. শীতলতা, ৮. বিনয়, ৯. জীবন এবং ১০. মৃদুতা।

আল্লাহপাক জাইতুনকেও বরকতময় বলেছেন। যেমন, ‘মুবারক গাছ জাইতুন তেল প্রজ্জ্বলিত হয়।’ (সূরা নূর, আয়াত: ৩৫)। জাইতুনকে মুবারক বলার কারণ হলো, এই গাছের ফল হযরত আদম (আ.) খেয়েছিলেন। জইতুনের তেল প্রদীপে ব্যবহৃত হয়, এর আলো অন্যান্য তেলের আলোর চেয়ে স্বচ্ছ। একে রুটির সাথে ব্যঞ্জনের স্থলে ব্যবহার করা হয়। এই তেল বের করার জন্য যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না। রাসূলে পাক (সা.) বলেন, জাইতুনের তেল খাও, শরীরে মালিশ কর, কেননা এটা কল্যাণময় বৃক্ষ।

হযরত ঈসা (আ.)কে মুবারক নামে ডাকা হয়েছে। কারণ, হযরত ঈসা (আ.) যেখানে আছেন, এই স্থান মুবারক। তিনি জন্মান্ধকে ভালো করে দিতে পারতেন। তার স্পর্শে কুষ্ঠরোগী ভালো হয়ে যেত। মৃতকে জিন্দা করতে পারতেন তিনি।

আল্লাহপাক কাবাঘরকে মুবারক বলেছেন, যেমন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর বা মানুষের জন্য নির্ধারিত রয়েছে সেটিই হচ্ছে এই ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬) এই ঘরকে বরকতময় বলার করণ হলো, এই ঘর তাওয়াফ করলে আল্লাহপাক সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। এভাবে শবে-বরাতকেও আল্লাহপাক মুবারক বলেছেন। কারণ, এই রাতে আল্লাহপাক তার বান্দাদের প্রতি অসংখ্য রহমত ও বরকত নাজিল করে থাকেন। বান্দাদের তওবা কবুল করে থাকেন।
রাসূলে পাক (সা.) বলেন, শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহপাক সর্বনি¤œ আসমানে নেমে আসেন। সমস্ত ক্ষমাপ্রার্থী মুসলমানকে মাফ করে দেন। তবে মুশরিক, হিংসাকারী, রক্ত সম্পর্ক ছিন্নকারী ও ধর্ষণকারী ছাড়া। আর যাদেরকে আল্লাহপাক ক্ষমা করেন না, তারা হলো, যাদুকর, গণক, অন্যায়ভাবে হত্যাকারী, অশ্লীল গায়ক, পরস্পর শত্রুতাভাব পোষণকারী, অত্যাচারী শাসক ও তার সহযোগী, মিথ্যা শপথে পণ্য বিক্রয়কারী, মদ্যপ, পরস্ত্রীগামী, মাতাপিতার অবাধ্য সন্তান, কৃপণ, পরোক্ষ নিন্দাকারী ইত্যাদি অর্থাৎ যে গুনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না।

শবে-বরাতের আমল

শবে-বরাতের জন্য নির্দিষ্ট কোন আমল নেই। তবে নফল নামাজ ও তাহাজ্জুদ যেভাবে পড়া হয়, সেভাবে বেশি বেশি করে নফল নামাজ পড়তে হবে। নিয়ত হলো, শবে-বরাতের দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ছি আল্লাহু আকবার। এভাবে দু’রাকাত করে যত ইচ্ছা নামাজ পড়া যাবে। যে কোনো সূরা দিয়ে নামাজ পড়া যাবে। তবে ইবাদতে একাগ্রতা থাকতে হবে। নামাজে ক্লান্তি এসে গেলে জিকির-আজকার, অথবা কুরআন তেলাওয়াত করা যেতে পারে। অর্থাৎ যে ইবাদতে বেশি স্বাদ পাওয়া যায় সে ইবাদত করাই ভালো। সাধ্যাতীত ইবাদত আল্লাহপাকের কাছে পছন্দনীয় নয়। ইবাদতের সংখ্যা বৃদ্ধির চাইতে আন্তরিকতা, খুসু-খুজু বৃদ্ধির প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া উচিত। মহব্বতের সাথে অল্প ইবাদত গাফলতি সহকারে অসংখ্য ইবাদতের চেয়ে শ্রেয়।

মুখে তওবা তওবা বললে তওবা হয়ে যায় না। প্রয়োজন হল অনুতাপ-অনুশোচনা, নির্জনে বসে জীবনে সমস্ত গুনাহের কথা মনে করে লজ্জায় কাতর হয়ে কাঁদতে হবে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, পাপী বান্দার চোখের পানি আল্লাহর ক্রোধাগ্নিকে নিভিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে, সারা বছর ফরজ নামাজ না পড়ে শবে-বরাতে হাজার রাকাত নফল নামাজ কোন কাজে আসবে না। ফরজ নামাজ কাজা থাকলে ঐ নামাজই পড়তে হবে।

শবে-বরাতের দোয়া

হযরত মা আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এক রাতে হুজুরকে না পেয়ে মনে করলাম তিনি হয়তো অন্য বিবির ঘরে আছেন, আমি তখন তাকে খুঁজার জন্য উঠলাম। এমন সময় আমার হাত তাঁর পা মোবারক স্পর্শ করল, আমি দেখলাম, তিনি সেজদারত আছেন এবং এই দোয়াটি পড়ছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার শরীর এবং আমার অন্তর তোমাকে সেজদা করছে। আমার অন্তর তোমার প্রতি ঈমান এনেছে। আমি তোমার নেয়ামতের শোকর করছি। আমি আমার জীবনের উপর জুলুম করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তুমি ছাড়া গুনাহ মাফ করার কেউ নেই। আমি তোমার আযাব থেকে বাঁচার জন্য তোমার আশ্রয় চাই। আমার ক্রোধ থেকে বাঁচার জন্য তোমার রেজামন্দি চাই। তোমার আযাব থেকে নিরাপদ থাকার জন্য তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। তোমার প্রশংসা বর্ণনা করে কেউ শেষ করতে পারবে না। তুমি নিজেই তোমার প্রশংসা করেছ। আর তুমিই তোমার প্রশংসা করার ক্ষমতা রাখ। অন্য কেউ পারবে না।’ মা আয়েশা (রা.) আরও বলেন যে, রাসূলে খোদা কখনও দাঁড়িয়ে যেতেন আবার কখনও বসে পড়তেন। এভাবে সকাল হয়ে গেল। এজন্য রাসূলে পাক (সা.)-এর পা ফুলে গিয়েছিল। আমি তাঁর পায়ে ফু দিতে দিতে বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমার মা-বাপ আপনার উপর কুরবান হোক, আপনার আগে পিছের সমস্ত গুনাহ কি আল্লাহপাক মাফ করে দেননি? তখন রাসূলে পাক (সা.) বললেন, আমি কি আল্লাহপাকের শোকর করব না?

যার সমস্ত গুনাহ আল্লাহপাক মাফ করে দিয়েছেন, যাকে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম করে পবিত্রতম করে সৃষ্টি করেছেন, তিনি সারারাত সেজদায় পড়ে কান্নাকাটি করতে ভোলেননি। আমরা কী করছি? আমরা তো গুনাহের সাগরে ডুবে আছি। একমাত্র আল্লাহপাকের রহমত ছাড়া পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এই বরকতময় শবে-বরাত পেয়েও কি আমাদের গুনাহের বোঝা কমাতে সক্ষম হচ্ছি? বর্তমানে আমরা তো এই রাতটিকে আনন্দের রাত হিসেবে উদযাপন করতে শুরু করে দিয়েছি। শরীয়তগর্হিত কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আনন্দ প্রকাশ করছি। যেমন আতশবাজি, মাজারে গিয়ে কবরকে সেজদা করা, দলে দলে হৈহুল্লোড় করা, মানুষের ইবাদতে বিঘœ সৃষ্টি করা, জীবজন্তুর আকৃতিতে পাউরুটি তৈরি করে বা ক্রয় করে সওয়াবের কাজ মনে করে ছেলেমেয়েদের খেতে দেয়া, মাইকে উচ্চৈঃস্বরে গান-বাজনা করা ইত্যাদি। তাই আসুন, এই রাতটিকে গনিমত মনে করে সমস্ত অবৈধ বেদাতি কাজ পরিহার করে একমাত্র আল্লাহপাকের রেজামন্দি ও নিজের গুনাহ থেকে তওবা করে কিছুটা হলেও পাপমুক্ত হতে চেষ্টা করি। মনে রাখবেন, এই রাতে তওবা করে আল্লাহপাকের দরবারে কান্নাকাটি করলে তিনি নিশ্চয়ই সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। এই সুবর্ণ সুযোগ কোনভাবে হাতছাড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই আসুন, এই রাতটিকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে আল্লাহপাকের ডাকের উপর সম্মান প্রদর্শন করি। আন্তরিকভাবে ইবাদত করে নিজেকে পাপমুক্ত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার খালেস বান্দা হিসেবে কবুল করে নিন। (সংকলিত)

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments