মানবচরিত্রের প্রধান ও সৎ গুণাবলির অন্যতম একটি সত্যবাদিতা। আর এই সত্যবাদিতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাইতো নবুয়তপ্রাপ্তির আগে থেকেই তাঁর সত্যবাদিতায় মুগ্ধ আরবরা সর্বজনীনভাবে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তাঁকে।
কুরাইশ গোত্রের সত্যবাদিতার স্বীকৃতি
নবুয়ত লাভের আগে থেকেই রাসুল (সা.) ছিলেন সত্যবাদিতার উজ্জ্বল উদাহরণ। বিখ্যাত সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে সহিহ বুখারিতে নবীজির সত্যবাদিতার একটি স্বরূপ এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা যখন এই আয়াত নাজিল করলেন, ‘তুমি তোমার কাছে আত্মীয়-স্বজনকে সতর্ক করে দাও’ তখন রাসুল (সা.) বের হয়ে সাফা পর্বতে গিয়ে উঠলেন এবং ‘ইয়া সবাহা’ (সকাল বেলার বিপদ সাবধান) বলে সবাইকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিলেন। আওয়াজ শুনে তারা বলল, এ কে? তারপর সবাই তাঁর কাছে গিয়ে সমবেত হলো। তিনি বলেন, আমি যদি তোমাদের বলি, একটি অশ্বারোহী সেনাবাহিনী এ পর্বতের পেছনে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে, তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? সবাই বলল, আপনার মিথ্যা বলার ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা নেই। তখন তিনি বলেন, ‘আমি তোমাদের আসন্ন কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সাবধান করছি।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৯৭১)
সত্যবাদিতায় স্ত্রী খাদিজার স্বীকৃতি
রাসুলের সত্যবাদিতার স্বীকৃতি কেবল সাধারণের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পারিবারিক জীবনে প্রিয় স্বামীর সত্যবাদিতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.)। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজির কাছে যখন প্রথম ওহি নাজিল হয় এবং ফেরেশতারা সজোরে চাপ দিয়ে তাঁকে কোরআন পাঠের নির্দেশ দেন, তখন তিনি ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে জীবননাশের শঙ্কাবোধ করেন। সংকটময় সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রিয় সঙ্গিনী খাদিজা (রা.)-এর কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন এবং কম্বল দিয়ে তাঁকে ঢেকে দেওয়ার কথা বলেন। তখন খাদিজা (রা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আপনি কখনো ভয় পাবেন না, বরং সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনই লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা আপনি তো আত্মীয়তার বন্ধন জুড়ে রাখেন, সত্য কথা বলেন, অনাথ-অক্ষমদের বোঝা বহন করেন, মেহমানদের মেহমানদারি করেন এবং হকের পথে আগত যাবতীয় বিপদে সাহায্য করেন।’… (বুখারি, হাদিস : ৩)
বাদশা হেরাক্লিয়াসের সত্যায়ন
আরবের তৎকালীন সময়ে বিশ্বনবীর সত্যবাদিতা ছিল তুমুল জনপ্রিয়তায়। সে সময়ের মুসলিমদের পাশাপাশি কাফির মুশরিকরাও নবীজির সত্যবাদিতার শতভাগ স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ একটি ঘটনা হাদিসের কিতাবগুলোতে উল্লেখ আছে। সহিহ বুখারির বরাতে ঘটনাটির বর্ণনা এরূপ, কুরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি; বরং নবীর বিরুদ্ধে কঠিন শত্রুতায় লিপ্ত ছিল।
একবার তিনি সিরিয়ায় ব্যবসার উদ্দেশ্যে সফর করেন। সে সময় সেখানকার বাদশা হেরাক্লিয়াস তাকে ডেকে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আলোচনার এক ফাঁকে হেরাক্লিয়াস তাকে জিজ্ঞেস করেন—‘আচ্ছা, এই যে নবী দাবিদার মুহাম্মদ, সে এখন যা বলছে তা বলার আগে তোমরা কি তাকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে? নবী দাবি করার আগে সে কি মিথ্যা কথা বলত?’ আবু সুফিয়ান উত্তরে বলল, ‘না। সে মিথ্যা কথা বলে না।’ হেরাক্লিয়াস তখন বলল, ‘আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, সে এখন যা বলছে (নবী দাবি করা) তা বলার আগে তোমরা কি তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে, তুমি বললে, না। আমি বুঝতে পেরেছি, যিনি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যাবাদী নন, তিনি আল্লাহর ব্যাপারেও মিথ্যাবাদী হতে পারেন না। আমার বিশ্বাস, তিনি সত্য নবী হিসেবেই আগমন করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৭)
আল্লাহ আমাদের নবীজির সত্যবাদিতার গুণে গুণান্বিত হওয়ার তাওফিক দান করুন।