কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আরিফুল হক কুমারের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রাজশাহীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রভাগে দেখা মেলে তার। কবি ও লেখকদের সংগঠন কবিকুঞ্জের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশিত কবিতার বই : ঘাসের আঙ্গোট (২০০৯), পোড়ামেঘ অথবা গোত্রহীন মৃত্যু (২০১১), স্বপ্নের উল্কি (২০১২), হাওয়ার লিরিক (২০১৫) ও পানপাত্রে ডাইনির ঠোঁট (২০২৭)।
আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ এখনকার পরিবেশে মিলালে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ভিন্নতা চোখে পড়ে?
: আমাদের কৈশোর আর তারুণ্য দারুণ সব রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে উত্তাল। ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, ৬ দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ইত্যাদি অনন্য ঘটনা প্রবাহে সমৃদ্ধ। আর এগুলো সবই একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে ধারাবাহিক সংগ্রাম তার নানা পর্যায়। তখন ধীরে ধীরে জাতীয় নেতারা এবং সামাজিক রাজনৈতিক পক্ষগুলো সংঘবদ্ধ হচ্ছে একটি চূড়ান্ত লড়াইয়ে জন্য। এরই ঐতিহাসিক পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। অনিবার্যভাবেই আমাদের নৈতিক, আদর্শিক ও মনন চর্চার ক্ষেত্রে তা প্রবল প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে।
আজ আমরা নতুন এক সংগ্রামে শামিল হয়েছি-মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার অনুযায়ী একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম। এসব কিছু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ সময়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। এমনকি বিশ্বসাহিত্যের নানাবিধ স্রোত আগের চেয়ে অনেক বেশি আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করছে। নানাক্ষেত্রে ভিন্নতা তো অনুভব করছি বটে। তবে আমার মনে হয় শেষ বিচারে এসব ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে একজন লেখক তাঁর লেখকসত্তাকে কতটা লালন করতে পারে?
: আজকের পরিমণ্ডলে প্রযুক্তি এবং পুঁজিবাদ কোনোটাকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সেদিক থেকে দেখলে এটা লেখকদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। আমার মনে হয় একজন লেখক সব সময়ই বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তার লেখকসত্তাকে বিকশিত করে চলেন। প্রসঙ্গত আমরা রুশ বিপ্লবোত্তর সময়ের কথা মনে করতে পারি যখন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ সাহিত্যাঙ্গনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু সাহিত্যিকরা নিজের মতো করে ধীরে ধীরে পথ খুঁজে নিয়েছেন, জীবনের পক্ষে শিল্পের পক্ষে সাহিত্যের অনিবার্যতাকে অবলম্বন করেছেন।
লেখক হওয়ার জন্য কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?
: বিষয়টি পুঁজিবাদী কেন্দ্রিকতার একটি প্রভাব। কেননা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সবকিছুকে পণ্য করে তুলতে চায়, সেই নিরিখে লেখকরা শহর বা কেন্দ্রে আসে-যেন সহজেই পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারে। এমনটা ঐতিহাসিকভাবে হয়ে আসছে। যেমন এ দেশে ব্রিটিশ আমলে কলকাতা, বাংলাদেশে ঢাকা। এক সময় ইউরোপে ছিল প্যারিস কিংবা লন্ডন। হাসান আজিজুল হক, হোসেনউদ্দীন হোসেন, রফিকুর রশীদ অথবা তারাশঙ্কর কিংবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রান্তে থেকেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। তবে অনেক লেখককে বাজারব্যবস্থার সুবিধা পেতে শহরের পরিমণ্ডলে চলে আসতে হয়। এর ভালোমন্দ দুটিই আছে। লেখক হওয়ার জন্য কেন্দ্র-প্রান্ত কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
: সব সময়ই নানা আঙ্গিকে ব্যক্তিই হচ্ছে সাহিত্যের অনিবার্য অবলম্বন। এখন পরিবার তার যৌথরূপ হারিয়েছে তাই মানুষের একাকিত্ব, আত্মপরায়ণতা, মনোবিকোলন এসব নিয়ে লেখালিখি হচ্ছে বেশি। তবে আমরা কৃষিনির্ভর সমাজের মানুষ। এখানে একার চাইতে বহুর ভূমিকা অগ্রগণ্য তাই আমার বিবেচনায় যূথবদ্ধ মানুষের বিষয়গুলো আসা উচিত। সম্প্রতি বিশ্বপরিস্থিতি, পরিবেশ বিপর্যয়, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং ন্যাটোকে অবলম্বন করে মার্কিনি কূটচাল আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে একা নয় বহুকে নিয়েই বাঁচতে হবে, এমনকি সাহিত্যেও তার প্রতিফলন হওয়া উচিত।
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
: বিষয়টি বহুমাত্রিক। ভালোবাসা মানুষের একান্ত এক অনুধ্যান কিন্তু সব সময়ই সমাজ ভালোবাসার অঙ্গনে ‘উটের গ্রীবা’ বাড়িয়ে দেয়। আমরাও, লেখকরাও এ বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত নই। আবার ভালোবাসা তো পরিকল্পনা করে হয় না। ‘কবে কোনখানে তার নূপুর উঠে বাজি’ তা কেউ বলতে পারে না।
আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান, কতটা বিকৃতির শিকার?
: মানব সভ্যতা ক্রমেই প্রকৃতি বিনাশী হয়ে উঠছে। ফলে সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটছে বৈকি। নিবিড় প্রকৃতি অনুধ্যান সাহিত্য ক্ষেত্রে বিরল হয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন মানুষের বিচিত্র সংগ্রাম আমরা দেখছি কিন্তু সেখানে সামগ্রিক প্রকৃতি কিংবা সৌন্দর্য মুগ্ধতা খুব একটা লক্ষণীয় নয়। কবিতার ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বজ কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এমনকি আল মাহমুদের মতো করে পাচ্ছি না।
প্রকৃতিকে-সৌন্দর্যকে মুনাফাসন্ধানী ব্যবস্থা পণ্য করে তুলছে, তাই হয়তো সাহিত্যে এসবের বিকৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়ে মুনাফা করার সংকীর্ণতা সাহিত্য ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে। এটা খুব বেদনার।
রাজশাহী জেলার সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?
: রাজশাহীতে সাহিত্য ও শিল্পচর্চার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে বলা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। বিভাগোত্তরকালে যখন বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় নেতাদের স্বাধীনতার প্রোজ্জ্বল রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশকে সংগঠিত করছেন তখন রাজশাহী দেশের সাহিত্যাঙ্গনেও অগ্রবর্তী ভূমিকা রেখেছে। শুরুর দিকে রাজশাহী সাহিত্য মজলিস, পরবর্তীতে কবি সিকান্দার আবু জাফরের নেতৃত্বে একটি সাহিত্য গোষ্ঠী এবং কবি রুহুল আমিন প্রামাণিক, কবি তসিকুল ইসলাম রাজার পরিচালনায় রবিবাসরীয় সাহিত্য আসর অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। রাজশাহী লেখক পরিষদ ও রাজশাহী সাহিত্য পরিষদও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে দীর্ঘকাল রাজশাহীতে বাস করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুস্তফা নূরউল ইসলাম, কবি আতাউর রহমান, কবি আবুবকর সিদ্দিক প্রমুখ। সম্প্রতি রাজশাহীতেই দেহ রেখেছেন কথাসাহিত্যের বরপুত্র হাসান আজিজুল হক। রাজশাহীর মনন জগৎ আলোকিত রেখেছেন প্রফেসর সনৎকুমার সাহা, কবি জুলফিকার মতিন প্রমুখ। তারা সবাই রাজশাহীর সাহিত্যাঙ্গনে অনন্য প্রভাবক হিসাবে দীপ্যমান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্বনন, চিহ্নসহ অনেক সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই আজো সক্রিয় কবি ও লেখকদের সংগঠন কবিকুঞ্জ। কবি রুহুল আমিন প্রামাণিক এ সংগঠনের সভাপতি হিসাবে সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, সঙ্গে আছেন কবি তসিকুল ইসলাম রাজা, কবি অনীক মাহমুদসহ অনেকেই।
তবে আক্ষেপের সঙ্গেই বলি রাজশাহীতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি, দু-একটি থাকলেও ততটা গতিবান নয়। রাজশাহীতে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের কয়েকটি সংগঠন থাকলেও তাদের নিজস্ব কোনো কার্যালয় নেই, এটা খুব কষ্টের। রাজশাহী থেকে মৃদঙ্গ, নদী, কবিকুঞ্জ, চিহ্ন, আনর্ত, নিরিখ, ম্যাজিক লণ্ঠন, উত্তরা এক্সপ্রেসসহ অনেক সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। জীবনানন্দ কবিতামেলার মতো আরও সাহিত্য সম্মেলন হওয়া উচিত। একটি পাক্ষিক অথবা মাসিক সাহিত্যপত্র প্রকাশের স্বপ্ন দেখি।
বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কেমন? কেমন হওয়া উচিত?
: রাষ্ট্র জনগণের, জনগণ রাষ্ট্রের মালিক। এ চিরায়ত রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য বঙ্গবন্ধু আর ত্রিশ লাখ শহিদ জীবন দিয়েছেন। আমরা অপেক্ষা করছি একটি মানবিক রাষ্ট্রের যেখানে মানুষ নিরাপত্তার সঙ্গে নিজ নিজ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাবে। সমতাভিত্তিক সমাজে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে নাগরিকরা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে বাস করবে।