Monday, March 27, 2023
spot_img
Homeজাতীয়লাগামহীন চাঁদাবাজি দায় নিচ্ছে না কেউ

লাগামহীন চাঁদাবাজি দায় নিচ্ছে না কেউ

কোনো কোনো স্থানে স্কয়ার ফুট হিসাবে বিক্রি, চক্রের সদস্যরা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা

ঈদের বাকি আর কয়েকদিন। এর মধ্যেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতকেন্দ্রিক বেচাকেনা জমজমাট। অনেক এলাকায় ফুটপাত চেনারই উপায় নেই। মূল সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত বসেছে দোকানপাট। অবৈধ দোকান বসিয়ে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য চললেও এ খাত থেকে সরকার পাচ্ছে না কোনো রাজস্ব। চাঁদাবাজিনির্ভর এই বাণিজ্য ঘিরে চলছে নানা অপতৎপরতা। অনেক এলাকায় ফুটপাত বিক্রি হয়েছে স্কয়ার ফুট হিসাবেও।

কতিপয় পুলিশ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতার আশীর্বাদে এখন ফুটপাতের মালিক বনে গেছেন হাজারো লাইনম্যান। দিনে কোটি কোটি টাকার চাঁদা তুলছে লাইনম্যানের অধীনে থাকা পেশাদার চাঁদাবাজরা। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ফুটপাতে ব্যবসা করতে ভাড়ার চেয়ে বেশি চাঁদা গুনতে হচ্ছে। টাকা খরচ করার পরও অবৈধ তকমা নিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হচ্ছে।

দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও বৈধতা পাচ্ছেন না ফুটপাতের হকাররা। পুনর্বাসনের জন্য স্থায়ীভাবে জায়গা নির্ধারণ করেও দেওয়া হচ্ছে না। এই চাঁদাবাজিনির্ভর ব্যবসার দায় কার? এমন প্রশ্নের সুরাহা নেই। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেপরোয়া চাঁদাবাজির সঙ্গে অগ্রিম অর্থ নিয়ে ফুটপাত বিক্রির এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চাঁদাবাজির এই দায় সরকারের। কারণ পুলিশ ও সরকারি দলের লোকজন এই চাঁদাবাজিতে জড়িত। এরা সবাই সরকারের অধীনে। তাই কেউ এর দায় না নিলেও তা সরকারকেই নিতে হবে। যদিও দায়বদ্ধতার কাঠামো ভেঙে গেছে। এটা তারই পরিণতি।

ফুটপাত অবৈধ দখলের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, কাউকে ফুটপাত দখল করতে দেওয়া হবে না। ফুটপাত জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ফুটপাতের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। ফুটপাত সচল রাখা গেলে রাজধানীর যানজটও অনেকটা নিরসন হবে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, দিলকুশা, ফকিরাপুল, বায়তুল মোকাররম, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, সায়েদাবাদ, ডেমরা, শনির আখড়া, সদরঘাট, নিউমার্কেট, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা ও উত্তরা এলাকার বহু স্পটে সারা বছরই ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করেন হকাররা। এই ব্যবসার কোনো অনুমোদন নেই। সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ফুটপাত ও রাস্তায় অবৈধ দোকান সাজানোর জন্য নিত্যদিন চাঁদা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। ঈদ এলে এই অপতৎপরতা বাড়ে কয়েকগুণ।

এতে রাজধানীজুড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। পথ চলতে ভোগান্তির শিকার হন পথচারীরা। বছরের পর বছর ধরে এই প্রবণতা চললেও কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এই ব্যবসা ঘিরে অবৈধ টাকার ছড়াছড়ি থাকায় যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারাও থাকেন চোখে কালো কাপড় বেঁধে।

হকার্স সমিতির তথ্য মতে, রাজধানীতে কমবেশি দেড়শ কিলোমিটার ফুটপাত এখন চাঁদাবাজদের দখলে। ঈদ সামনে রেখে নিয়মিত চাঁদার হারের প্রায় দ্বিগুণ গুনতে হচ্ছে হকারদের। যারা চাঁদা তোলেন, তারা হকারদের কাছে লাইনম্যান ও তোলাবাজ হিসাবে পরিচিত। এরাই বকশিশের নামে আদায় করছে বাড়তি টাকা। দেড়শ কিলোমিটারের এই ফুটপাত থেকে দিনে কয়েকশ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। আবার ফুটপাতে ‘পজেশন’ বিক্রি করা হয়েছে স্কয়ার ফুট হিসাবে। ২৪ স্কয়ার ফুটের একটি জায়গায় চৌকি ফেলতে অগ্রিম চাঁদা গুনতে হয় ১০ হাজার টাকা। প্রতি স্কয়ার ফুটের দাম পড়ে প্রায় ৪০০ টাকার বেশি। এ হিসাবে দেড়শ কিলোমিটার ফুটপাত বিক্রি করে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চাঁদাবাজচক্র।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যদি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বৈধভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে এ টাকা সরকারের রাজস্ব খাতে জমা হতো। সেই ব্যবস্থা না থাকায় সরকার বছরে বিপুল টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। বিপরীতে ভারী হচ্ছে চাঁদাবাজদের পকেট।

জানা গেছে, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ দায়িত্ব পালনকালে ওসমানী উদ্যান, মুক্তাঙ্গন, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, মিরপুর, শাহ আলী, পান্থপথ ও আজিমপুর-এই আটটি এলাকায় হকারদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে মোট ২০টি এলাকায় হকারদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব করা হয়। ওই সব এলাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হকাররা বসতেও শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি।

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা দুই লাখ ৬০ হাজার। এর মধ্যে মূল রাস্তার ফুটপাতে দোকান আছে ৭৫ হাজারের মতো। এই দোকানদাররা প্রতিদিন ২০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ হিসাবে গড়ে ৪০০ টাকা করে দিনে চাঁদার অঙ্ক দাঁড়ায় ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেট সোসাইটি, মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্স, শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্সের সামনের ফুটপাত ও রাস্তার হকাররা চাঁদাবাজদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মী পরিচয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফুটপাত থেকে তোলা হচ্ছে চাঁদা।

মিরপুর, পল্লবী, দারুস সালাম, কাফরুল, শাহ আলী এলাকায় ফুটপাতে দোকান আছে সাত হাজার। প্রতিদিন প্রতিটি দোকান থেকে গড়ে ৭০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। মিরপুর ২ নম্বর, ১০ নম্বর ও আশপাশের এলাকায় ফুটপাত চেনার উপায় নেই। এখান থেকেও তোলা হচ্ছে চাঁদা। এসব চাঁদাবাজির ঘটনায় বরাবরই পুলিশের নাম আলোচিত হয়। লাইনম্যানদের তোলা চাঁদার অর্ধেক যায় পুলিশের পকেটে।

চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, ‘ফুটপাতে চাঁদাবাজির সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে জড়িতদের নিস্তার নেই। এর আগেও চাঁদাবাজদের গ্রেফতার করে মামলা দেওয়া হয়েছে।’

জানা গেছে, গুলিস্তান, জিপিও, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, সদরঘাট, এলাকায় ফুটপাত হকারদের দোকান আছে অন্তত ২০ হাজার। এসব এলাকার প্রতি দোকানদার ৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিচ্ছেন। বায়তুল মোকাররমের সামনের দোকানদার হানিফ মিয়া বলেন, ‘আমাদের লাভের গুড় পিঁপড়ার পেটে যায়। সারাদিন রোদে দাঁড়িয়ে বেচাকেনা করে যা কামাই করি তা থেকে বিভিন্ন জনকে বখড়া দিতে হয়। আমাদের পকেটে লাভের সামান্যই থাকে।’

আরও জানা গেছে, ফকিরাপুল, মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে টিকাটুলী মোড় পর্যন্ত ফুটপাত, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের রাস্তা ও বঙ্গভবনের উত্তর পাশের রাস্তার ফুটপাতের দোকান আছে ১০ হাজার। মতিঝিল শাপলা চত্বরের হকার রফিক উদ্দিনের কাছে চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এগুলা বইল্যাই কি হইব। লেইখ্যাই কি হইব। আমরা বলি। আপনারা ল্যাখেন। কিন্তু কোনো কাম হয় না। বছরের পর বছর ধরে চলা এই চাঁদাবাজি যাগোর বন্ধ করবার কথা তাগোই বেশি দিতে হয়। থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ, টহল পুলিশের নামে চান্দা উঠানো হয়।’

জানতে চাইলে পুলিশের নামে চাঁদাবাজির বিষয় অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মতিঝিল জোন) মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, ‘ফুটপাতে যেন কেউ চাঁদাবাজি করতে না পারে সেজন্য নজরদারি রয়েছে। পুলিশের নাম ভাঙিয়ে কেউ চাঁদাবাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে জড়িতদের আইনে আওতায় আনা হবে। হকারদের পুনর্বাসন করে সব ফুটপাত দখলমুক্ত করার পক্ষে মত দেন তিনি। বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেলে চাঁদাবাজি নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।’

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের নেতারা বলেন, চাঁদাবাজদের অত্যাচারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। প্রতিদিন সব কটি ফুটপাতের দোকান থেকে শাসক দলের নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাস্তানরা চাঁদা নিচ্ছে। সরকারের শীর্ষ মহলকে অবহিত করার পরও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সরকার মাসে কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে পারত। প্রধানমন্ত্রী পুনর্বাসনের ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা কার্যকর হচ্ছে না।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments