রোহিঙ্গা ইস্যুসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সঙ্কটে জাতিসংঘের ভূমিকায় খানিকটা হতাশা প্রকাশ করে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আমরা আরও স্বচ্ছ ও দক্ষ জাতিসংঘ চাই, যেখানে জরুরি প্রয়োজনে বৈশ্বিক ওই সংস্থা দায়িত্বশীল এবং কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান প্রশ্নে জাতিসংঘের ভূমিকায় আমরা হতাশ। বৃহস্পতিবার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ (সিপিএস) ও জাতিসংঘ ঢাকা অফিসের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে তিনি এসব কথা বলেন। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর পূর্তিতে ‘জনগণের প্রয়োজনের সময়ে জাতিসংঘ: বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা নিয়ে পুনর্ভাবনা’ শীর্ষক দুই দিনের ওই আলোচনার (ওয়েবিনার) সমাপনী দিন ছিল বৃহস্পতিবার। এতে বক্তাদের তরফে বলা হয়Ñ বৈশ্বিক ওই সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্র নয়, মানুষের কল্যাণ এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতিসংঘকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। কারণ জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে অনেকের মাঝে হতাশা রয়েছে। সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো এম. শহীদুল হক গোটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
ওয়েবিনারে জাতিসংঘের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা হয়। নাগরিক সমাজের বিবেচনায় জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ বিষয়েও কথা হয়। জাতিসংঘে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব নেয়া মাসুদ বিন মোমেন বলেন, জাতিসংঘে এক ধরনের পরিবর্তনের সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে সব দেশ সমানভাবে এই পরিবর্তনে যুক্ত হচ্ছে না। অনেকে দায়িত্বশীল ও সহযোগী হয়ে এই প্রক্রিয়াকে সাপোর্ট করছে, আবার অনেকে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করছে। ফলে জাতিসংঘ এখনো ট্রানজিশনাল বা অন্তবর্তীকালীন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ৭৫তম বছরপূর্তির এই সময়ে এসে অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে আমরা আসলে কোথায় যেতে চাই? জাতিসংঘের প্রতি বাংলাদেশের প্রত্যাশা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশ বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামো যে যথেষ্ট নয়, সেটা নিরাপত্তা পরিষদের ভোট হোক, প্রবল শক্তিধর দেশগুলোর দ্বৈরথই হোক না কেন, তা স্পষ্ট। কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বললে জানমনে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে কি হতাশা রয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যাবে। তবে হ্যাঁ, এটা সত্য জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার বিষয়টি দেখছে। কিন্তু এটা তো সমাধান নয়, বাস্তুচ্যুত ওই ১১ লাখ মানুষকে মর্যাদার সঙ্গে তাদের বসতভিটায় অর্থাৎ রাখাইনে প্রত্যাবাসনসহ দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ওই সমস্যা সমাধান করতে হবে। গুরুতর বিষয় হচ্ছেÑ এ বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে এখনো স্বচ্ছ কোন পথ নকশা নেই। ওয়েবিনারে ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সমীর শরণ বলেন, বর্তমান দুনিয়া হচ্ছে এশিয়ার দুনিয়া। জাতিসংঘে এশিয়ার প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব থাকতেই হবে। এশিয়া পরিস্থিতির জটিলতা নিরসন এবং সবার একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস চীন ও ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলো এক সময়ে সংলাপে বসবে। নিজেদের উপলব্দি থেকেই জটিল বিষয়গুলোর সমাধান করবে। সমাপনী পর্বে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেন, তরুণদের নেতৃত্বে নাগরিক সমাজের কর্মকা- ক্রমশ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ নানা ইস্যুতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। তাঁর মতে, জাতিসংঘের সিস্টেমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে, তবুও তাদের কাজের ক্ষেত্রে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনুষ্ঠানে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, বড় বড় এনজিওগুলো জাতিসংঘের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, কিন্তু যাদের তহবিল সংকট বা কম, অপেক্ষাকৃত ছোট এনজিও, তাদের তাদের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ‘জাতিসংঘের খোলনলচে পরিবর্তনের সময় এসেছে’ বলে মন্তব্য করেন। ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেন্সজে তেরিঙ্ক বলেন, মানুষের কল্যাণ বিবেচনায় জাতিসংঘকে কাঠামোবদ্ধ নয়, বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ইইউ সেই শূন্যতা পূরণে কাজ করছে। ওয়েবিনারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগান্তকারী প্রকল্প এটুআই’র পলিসি পরামর্শক আনিস চৌধুরী বলেন, ‘জাতিসংঘ এবং এর অধীন সংস্থাগুলো বাংলাদেশসহ অন্য দেশের জনগণের জন্য সহজভাবে ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি তৈরি করতে সহায়তা করছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আতিকুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘকে মানুষকেন্দ্রিক হতে হবে এবং পরিচালনায় প্রয়োজনীয় এবং মানানসই পরিবর্তন আনতে হবে। অনুষ্ঠানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ভূ-রাজনীতি ও আঞ্চলিক বিষয়ক এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় কেন্দ্রের প্রধান শেখ তানজীব ইসলাম এবং ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন ইয়ুথ অ্যান্ড স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট স্যামি ওয়াদুদ ছাড়াও অনেক গবেষক বক্তব্য রাখেন।