রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। হাদিসের ভাষায় ‘শাহরুল আজিম’ ‘শাহরুম মুবারাকাত’ এ মাস বিশেষ বৈশিষ্ট্যে অনন্য—(ক) এ মাসে কোরআন নাজিল হয়, (খ) হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’, (গ) শয়তান বন্দি থাকে, (ঘ) মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমায় সমুজ্জ্বল। (ঘ) এ মাসেই যথাক্রমে জাবুর ০৬, তাওরাত ০১, ইঞ্জিল ১২ রমজান অবতীর্ণ।
আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) ‘আহকামে ইসলাম আকল কী নজর মে’ গ্রন্থে রোজার কয়েকটি উপকারিতা বর্ণনা করেন : (১) রোজা দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর আকলের (জ্ঞান) পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় (২) অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হয় (৩) স্বভাবে বিনয়-নম্রতা সৃষ্টি করে (৪) মানুষ ফেরেশতা চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছে যায় (৫) মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে আত্মশুদ্ধি ও ধর্মভীরুতার দ্বারা ‘সিফাতের ব্বানি’ বা আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয় মুমিন বান্দা, জেগে ওঠে আল্লাহর ভালোবাসা : ‘রোজা পালন করা আল্লাহর প্রতি গভীর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন। কেননা, কারো প্রতি মহব্বত জন্মিলে, তাকে লাভ করবার জন্য প্রয়োজনে প্রেমিক পানাহার বর্জন করে এবং সব কিছু ভুলে যায়। ঠিক তেমনি রোজাদার ব্যক্তিও আল্লাহর মহব্বতে দেওয়ানা হয়ে সব কিছু ছেড়ে দেয়। এমনকি পানাহার পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই রোজা হলো আল্লাহর মহব্বতের অন্যতম নিদর্শন। ’ (ফাতওয়া আলমগিরি ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা ২০২)
কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান ইসলাম ও মুসলমানের ক্ষতি সাধনের জন্য পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ‘মানব-দানব’ দুই রূপেই তৎপর। মহান আল্লাহর সতর্কবাণী—বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি…আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য থেকেও। ’ (সুরা নাস, আয়াত : ০১-০৬)
ধূর্ত ও কপট অপশক্তি ‘শয়তান’ মানুষকে ধাপে ধাপে বিভ্রান্ত, পাপগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত করে জাহান্নামি বানায়। ইমাম ইবনু কাইয়্যুম জাওজিয়া (রহ.) শয়তানের ছয়টি অপকৌশল বর্ণনা করেন, যথা—(ক) মানুষকে শিরক ও কুফরে লিপ্ত করা (খ) বিদআতে (ধর্মীয় নতুনত্বে) জড়িয়ে দেওয়া (গ) কবিরা গুনাহে আকৃষ্ট করা (ঘ) ন্যূনতম হলেও ছগিরা গুনাহে উদ্বুদ্ধ করা (ঙ) ‘মুবাহ’ তথা করলে সওয়াব নেই, না করলে গুনাহ নেই এমন কাজে ব্যস্ত রাখা এবং প্রয়োজনীয় জরুরি ইবাদতকে গৌণভাবে দেখানো (চ) ফরজ ছেড়ে সুন্নত নিয়ে ব্যস্ত রাখা এবং অধিক পুণ্যময় আমলের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতায় মানুষকে ক্লান্ত করা।
শয়তান থেকে বাঁচার উপায় : (ক) পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, (খ) তাসবিহ-তাহলিল পাঠ, (গ) নামাজের মধ্যে ওয়াসওয়াসা দানকারী ‘খিনজাব’ নামক শয়তান সম্পর্কে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন, (ঘ) কারো প্রতি অস্ত্র দ্বারা ইশারা না করা (ঙ) দলগত-সুসংহত জীবনযাপন, (চ) শরিয়া ও সুন্নাহ মেনে চলা, (ছ) শয়তান প্রতিরোধী দোয়া-কালাম পড়া।
শয়তানের বন্দিত্ব প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘রমজানের প্রথম রাতেই শয়তান ও দুষ্ট জিনদের রশি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়…। ’ (তিরমিজি)
তিনি আরো বলেন, ‘রমজান মাসে বড় শয়তানকে আটক করা হয়। ’ (নাসায়ি)
জিজ্ঞাসা হলো, তবু কেন পাপাচার বন্ধ হয় না। কারণ হিসেবে বলা চলে—
ক) মানুষ পাপে লিপ্ত হয় দুই কারণে ১. কুপ্রবৃত্তি ও বদ-অভ্যাসে, ২. শয়তানের প্ররোচনায়। কাজেই রমজানে শয়তান বন্দি থাকলেও মানুষ কুপ্রবৃত্তির প্রভাবে পাপাচারে লিপ্ত হয় (ফতহুল বারি)।
খ) কাজি ইয়াজের (রহ.) মতে, ‘শয়তান বন্দি’ কথাটি আক্ষরিক ও রূপক উভয়ই হতে পারে। রূপকার্থের উদ্দেশ্য হলো রমজানে শয়তানের প্রবঞ্চনা কমে যায়, অন্যায় কম হয়, মানুষের ইবাদতে আগ্রহ প্রবল হয়।
গ) শয়তানকে ওই সব রোজাদার থেকে দূরে রাখা হয়, যারা রোজার আদব ও শর্ত বজায় রাখে। (উমদাতুল কারি)।
ঘ) রমজানে জিন শয়তান বন্দি হয়, ফলে মানুষের মধ্যকার শয়তানিও অবদমিত হয়। তবে ওই সব দূরাচারীর কথা ভিন্ন, যারা ইবাদতে যোগ্যতা হারিয়ে এমন—‘জিহ্বায় তুমি মুমিন/অন্তরে তুমি মুনাফিক’। [আ. কাদির জিলানি, (রহ.)]
শয়তান বন্দি থাকলেও শয়তানি ছাড়ে না এরাই। যেমন ফ্যান বন্ধ করলেও ঘুরতে থাকে অথবা গরম লোহা সহসা শীতল হয় না।
ঙ) বন্দিত্বের কারণে শয়তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব কমে; কিন্তু মানুষের কুপ্রবৃত্তির মধ্যে পরোক্ষ তৎপরতা থেকেই যায়।
বস্তুত ‘শয়তানি’ দৃশ্যমান হলেও ‘শয়তান’ এক অদৃশ্য অপশক্তি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। ’ (সুরা ফাতির, আয়াত : ০৬)
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ-বিফল প্রমাণ করতে ‘শয়তান’ মানুষের ইবাদত ও ইহ-পারলৌকিক উন্নতির সব পথে প্রতিবন্ধকতার সব উপায় অবলম্বন করে। সুতরাং ‘শয়তান’ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো মহান আল্লাহর রহমত ও আশ্রয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘বলো, হে আমার রব, আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি। ’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ৯৭)
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর