তুরস্কের উসমানীয় সুলতানদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ইসলামী অনুশাসন। উসমানীয় সুলতানদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে ইসলাম পরিপালনে তাঁদের আন্তরিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। সুলতানদের রাজদরবার ঘিরেও ছিল নানা ধর্মীয় আয়োজন। রমজানে আলেমদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ছিল তেমনি একটি রাজকীয় আয়োজন; ১৯২৪ সালে উসমানীয় খেলাফতের আনুষ্ঠানিক পতনের আগ পর্যন্ত যা অব্যাহত ছিল।
তুর্কি রমজানে ধর্মীয় আলোচনার রীতি, যা হুজুরে হুমায়ুন ওয়াজ নামে পরিচিত; তা বেশ পুরনো হলেও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে। রমজানে সুলতানের উপস্থিতিতে প্রাজ্ঞ আলেমরা কোরআনের ব্যাখ্যা করতেন। এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করত ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। তারা প্রশ্ন করারও সুযোগ পেত। বার্ষিক এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো ইস্তাম্বুলে অবস্থিত উসমানীয় সুলতানের বাসভবন কোপকাপি প্রাসাদে। ১৯২৪ সালে উসমানীয় খেলাফতের অবসান ঘটার আগ পর্যন্ত ১৬৫ বছর পর্যন্ত এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের সূচনালগ্ন থেকেই তুর্কি সমাজে সংবেদনশীল ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্কের ধারণাটি নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুলতানরা রাষ্ট্রের জ্ঞানী ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। যেন রাষ্ট্রের জ্ঞানচর্চা ও ধর্মীয় জীবনকে নিশ্চিত করা যায়। উসমানীয় রাজপরিবার ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ করতে পারে। একই কারণে উসমানীয় সুলতানরা গুরুত্বের সঙ্গে ধর্মীয় পণ্ডিতদের তাঁদের শিষ্যসহ রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তাঁদের কাউকে কাউকে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতেন। ইস্তাম্বুল বিজয়কারী ফাতিহ সুলতান মেহমেদ, যিনি অত্যন্ত প্রতাপের সঙ্গে রাজ্য শাসন করেছেন এবং সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যান, তিনি সমাজের জ্ঞানী-গুণী ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের সঙ্গে রাজপরিবারের সংযোগকে নতুন মাত্রা দান করেন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতেন এবং তুর্কিদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় জীবনকে উৎসাহিত করতেন।
জোহর থেকে আসরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে কমপক্ষে ছয়জন পণ্ডিত প্রথম পর্বের আলোচনায় অংশ নিতেন। এই আলোচনাকে ‘হুজুরে হুমায়ুন বক্তৃতা’ বলা হতো। কেননা তা সুলতানের উপস্থিতিতে হতো। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের আলোচনা শুনতেন। রাজদরবারে এত দীর্ঘ সময় ধরে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলার ইতিহাস খুবই বিরল। আলোচনায় যারা অংশ নিতেন তাদের বলা হতো ‘মুকাররির’ (বক্তৃতা পেশকারী) এবং যারা প্রশ্ন করতেন ও আলোচকের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন তাদের বলা হতো ‘মুখাতাব’ (শ্রোতা)। অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মুকাররিরের বিপরীতে থাকত পাঁচজন মুখাতাব। সময়ের বিবেচনায় কখনো কখনো আলোচকদের সংখ্যা ওঠা-নামা করত।
বিতর্ক অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো ‘শেইহুল ইসলামিক’ (শায়খুল ইসলামের অফিস) কর্তৃক। শায়খুল ইসলাম ছিলেন রাষ্ট্রের ধর্মীয় নির্দেশনা (ফাতাওয়া) জারির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব। বার্ষিক বিতর্কে আলোচনার জন্য শায়খুল ইসলাম রমজানের ১৫ দিন আগেই কিছু সুরা ও আয়াত ঘোষণা করতেন। এরপর আলোচক ও বিতার্কিকরা এ বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। আলোচকরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। আলোচক একেকটি আয়াত তিলাওয়াত করে তার ব্যাখ্যা করতেন এবং শ্রোতারা তাঁকে প্রশ্ন করলে তার উত্তর দিতেন।
বেশির ভাগ আলোচক তাদের আলোচনা প্রস্তুত করতেন ১৩ শতকের আইনবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক ও তাফসিরবিদ কাজি বায়জাভি (রহ.)-এর অনুসরণে। তারা কোরআনের ব্যাখ্যায় হাদিস, ফিকহ (ইসলামী আইন বিজ্ঞান), ইতিহাস ও ভূগোলের সহায়তা গ্রহণ করত। এটা ছিল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মীয় কার্যক্রম। যা উসমানীয় রাজপরিবারের যুক্তিবাদী ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারাকে উন্নত করেছিল। আলোচকরা তাদের আলোচনার মাধ্যমে প্রায়ই সুলতানের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করতেন। সভাস্থলে বসার স্থান সুলতানই নির্ধারণ করে দিতেন। মুকাররির সুলতানের ডানদিকে বসতেন এবং মুখাতাবরা অর্ধ-বৃত্তাকার হয়ে মুকাররিরের সামনে বসত। অংশগ্রহণকারী শ্রোতাদের নামের তালিকাও সুলতান চূড়ান্ত করত।
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের সময় রমজান মাসে ইলজিদ প্রাসাদে সপ্তাহে দুই দিন আলোচনা অনুষ্ঠিত হতো। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের তাতে আমন্ত্রণ জানানো হতো। সুলতান ওয়াহিদুদ্দিন ও খলিফা আবদুল মেসিদ আফেন্দি অনুষ্ঠানটি ডলমাবাচি প্রাসাদে অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে মে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমানে রমজান মাসে মরক্কোর সুলতানের উপস্থিতিতে উসমানীয় আমলের অনুরূপ ধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তৃতাগুলো আরবি ও ইংরেজি ভাষায় ‘আল-দুরুস আল-হাসানিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়। তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় পণ্ডিতদের তাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড