Friday, July 26, 2024
spot_img
Homeজাতীয়রণক্ষেত্র নয়াপল্টন

রণক্ষেত্র নয়াপল্টন

অ্যাকশনে পুলিশ, নিহত ১, রিজভী, আমান, সালাম, শিমুল, খোকন, এ্যানীসহ গ্রেপ্তার ৪ শতাধিক, বিক্ষোভের ডাক

বিভাগীয় সমাবেশের আগে গতকাল নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। তাদের মধ্যে দলীয় কর্মী, পথচারী ও পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। নিহত মকবুল হোসেন রাজধানীর বাউনিয়াবাদ এলাকার বাসিন্দা। তিনি নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচ তলায় গুলিবিদ্ধ হন বলে দলীয় কর্মীদের   দাবি। নিহত মকবুল জুতায় চুমকি লাগানোর কাজ করতেন। সংঘর্ষের পর সাড়ে চারশ’ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বলেন, ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ বানচাল করতেই পরিকল্পিভাবে এই হামলা চালিয়েছে পুলিশ। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সড়ক থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের সরাতে গেলে তারা আগে হামলা করে।

বেলা তিনটা থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেমে থেমে চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এ সময় পুলিশের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় আশপাশের সড়কে যান চলাচল। টানা গুলি ও টিয়ারশেলে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা আশপাশের গলি ও সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। নয়া পল্টন থেকে নেতাকর্মীরা সরে গেলে সেখানে অভিযান শুরু করে পুলিশ। 

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রবেশ করে দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাসহ অবস্থান করা নেতাকর্মীদের আটক করে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাতে কার্যালয়ের কম্পিউটারসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদিও জব্দ করে ডিবি। আটক নেতাকর্মীদের ডিবি কার্যালয় ও আশপাশের থানায় নেয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে অন্তত ২২ জন চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া পল্টনের আশপাশের হাসপাতালেও চিকিৎসা নিয়েছেন অনেকে। নয়াপল্টনে অভিযানে পুলিশ ও ডিবি’র সঙ্গে বিশেষায়িত  সোয়াত এর সদস্যরাও অংশ নেন। সংঘর্ষের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিএনপি কর্মীদের রাস্তা থেকে সরাতে গেলে পুলিশের ওপর তারা চড়াও হয়। পুলিশ বাধ্য হয়ে অ্যাকশনে যায়। সড়কে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না বলেও তিনি জানান।


ওদিকে নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আজ দেশব্যাপী মহানগর ও জেলা পর্যায়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বিএনপি। গতরাতে দলটির স্থায়ী কমিটির এক ভাচ্যুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভা থেকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করা হয়। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। 


যেভাবে সংঘর্ষের সূত্রপাত: সকাল থেকেই দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিতে থাকেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ঢাকা ও বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আগত এসব নেতাকর্মী বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সেøøাগান দিতে থাকেন। অনেকে রাস্তায় বসেও সেখানে অবস্থান নিচ্ছিলেন। শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল তাদের অবস্থান। দলীয় কার্যালয়ের দুই পাশেই পুলিশ অবস্থান নেয় সকাল থেকেই। এক পর্যায়ে বেলা ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে পুলিশ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত বিএনপি নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এবং তারা দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। তখন সেখান থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তার কিছুক্ষণ পর বিএনপি নেতাকর্মীরা চারদিক থেকে পুলিশকে ঘিরে বিভিন্ন সেøøাগান দিতে থাকেন।

 তখন পুলিশ মারমুখো হয়ে উঠলে বিএনপি নেতাকর্মী পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ধাওয়া দিতে থাকেন। তখন পুলিশ তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয় এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। এরপর একের পর এক দু’পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ চলতে থাকে। শুরুতে বিএনপি’র দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত এই সংর্ঘষ চলতে থাকে। পরে বিজয়নগর হোটেল ৭১ পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ চলে। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা বিজয়গরসহ আশপাশের বিভিন্ন গলি ও দোকানপাটের মধ্যে অবস্থান নেন। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ নাইটিঙ্গেল মোড় এলাকা ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। এ সময় বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে আটক করে নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ডিবি’র গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

 এরপর নয়াপল্টনের মূল সড়কে নেতাকর্মীর সংখ্যা কমে যায়। তাদের অনেকে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করেন। এ সময় পুলিশ কার্যালয়ে প্রবেশ করে নেতাকর্মীদের আটক করে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায়। দফায় দফায় নেতাকর্মীদের আটক করা হয়। সংঘর্ষের খবর পেয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলম বিএনপি কার্যালয়ের সামনে আসেন বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে। তিনি এসে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চাইলেও তাকে সেখানে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। পরে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ফখরুল। রাত আটটা পর্যন্ত কার্যালয়ের সামনের সড়কেই তিনি বসে ছিলেন। রাত আটটার পর মির্জা ফখরুল নয়া পল্টন ছেড়ে যান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গুলশানে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে রাতে তিনি সেখানে যাচ্ছেন। ১০ই ডিসেম্বর সমাবেশের বিষয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি জানান। 


আটক হলেন যারা: বিকাল সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ সময় বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। কিছুক্ষণ পর দলীয় কার্যালয় থেকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা উত্তর বিএনপি’র আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণ বিএনপি’র আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, গাজীপুর জেলা বিএনপি’র সভাপতি ফজলুল হক মিলন, মৎস্যজীবী দলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম মাহতাব, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী এডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ঢাকা জেলা বিএনপি’র সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, ওলামা দলের আহ্বায়ক শাহ মোহাম্মদ নেসারুল হককে আটক করে নিয়ে যায় ডিবি। পরে আরো কয়েক দফায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থাকা অনেক নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। আটক নেতাকর্মীদের ডিবি কার্যালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন থানায়ও নিয়ে যাওয়া হয়। 


আহত যারা: সংঘর্ষে আহত নেতাকর্মী ও একজন পুলিশ সদস্যকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এর মধ্যে ছিলেন, মো. রবিন খান, মো. আনোয়ার ইকবাল (বোরহান উদ্দিন কলেজ ছাত্রদল), মো. খোকন, মো. মনির হোসেন, মো. রাশেদ (পল্টন থানা যুবদল), মো. ইয়াসির আরাফাত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, জসীমউদ্দীন হল), মো. সুমন (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদল), মো. জহির হাসান (ছাত্রদল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়), মো. শামীম (রূপনগর থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো. হানিফ, মো. হৃদয় (কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো. মকবুল হোসেন (কদমতলী থানা স্বেচ্ছাসেবক দল), মো. ফারহান আরিফ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মো. নূরনবী (শাহবাগ থানা যুবদল), মো. সুলতান আহমেদ (শাহ আলী থানা যুবদল), মনির (শাহবাগ থানার যুবদল), মো. আমিনুল ইসলাম (শেরেবাংলা নগর থানা যুবদল), মো. আশরাফুল ইসলাম (গুলশান থানা ছাত্রদল), বিপ্লব হাওলাদার (ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল), মো. আসাদুজ্জামান (ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদল), মো. মেহেদী হাসান নয়ন (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল)। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের ১৮ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। 
নিহত মকবুল হোসেনের স্ত্রী হালিমা ঢামেকের মর্গে স্বামীর লাশ শনাক্ত করেন। তিনি জানান, আমার স্বামী কারচুপির কাজ করতেন। আজ বাসা থেকে তার বোনের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে বের হন। কারচুপির পুতি কেনার জন্য। আর আমরা পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে এসে জানতে পারি আমার স্বামী পল্টনে পুলিশের গুলির ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তিনি জানান, আমাদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও থানায়। আমরা মিরপুর-১১ বাউনিয়াবাদ এলাকায় থাকি। মকবুলের স্ত্রী জানান, তাদের একমাত্র সন্তান মিথিলার বয়স ৮ বছর। হালিমার সঙ্গে আসা তার ৮ বছর বয়সী মেয়েও বাবার জন্য বিলাপ করছিল। 
চিকিৎসা নিতে আসা আহত যুবদল কর্মী জহির হোসেন বলেন, আত্মরক্ষার্থে পার্টি অফিসের ভেতরে ঢুকলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে তাদের ওপর গুলি চালায়। নিচতলার কেচিগেট ভেঙে পুলিশ ভেতরে ঢুকে পাখির মতো গুলি চালায় আমাদের ওপর। চোখের সামনে মকবুল মারা যান। এ সময় ২০ জনের মতো আহত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, মোট ২১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে আসেন। একজন মারা গিয়েছেন। বাকি তিনজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা শঙ্কামুক্ত। আহতদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments