তিনি বলেন, ‘একদা আমরা খুশির আভা দেখতাম সবার চোখেমুখে, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আমাদের ঘুম ভাঙত।
একটি যুদ্ধবিরতির জন্য আশায় বুক বেঁধে আছে ভাগ্যাহত গাজাবাসীরা। মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা গাজা উপত্যকাকে যুদ্ধবিরতি ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। গত নভেম্বরের শেষের দিকের মতো, তখন ইসরায়েলি বিমানের বিকট আওয়াজ এবং বোমাবর্ষণের কানফাটা শব্দ পুরো সাত দিন বন্ধ ছিল। তবে কায়রো, দোহা ও প্যারিসের বৈঠকে বারবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও গাজার অনেকে নিরাশ নয়।
অন্যদিকে রাফা শরণার্থী শিবিরের তাঁবুতে তাঁবুতে এখন এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রাণের ভয়ে ছুটে বেড়ানো মানুষগুলো কেবল একটি শান্তিচুক্তির জন্য অধীর প্রতীক্ষায়। তখন হয়তো তারা সমাধিহীন মৃতদেহের জন্য কবরের সন্ধানে একটু বের হতে পারবে। বোমা হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ফেলে আসা ঘরবাড়ি দেখতে নিজেদের এলাকায় ফিরতে পারবে।
ইমান সালামা গাজা উপত্যকার উত্তরের বাসিন্দা। অন্য হাজারো বাসিন্দার মতো তিনিও যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন রাফার তাঁবুতে। ইমান বলেন, ‘একটি যুদ্ধবিরতিই কেবল এখানকার মানুষের ক্ষীণ আশা জিইয়ে রেখেছে।’
কণ্ঠে একরাশ ক্লান্তি ও বিষণ্নতার ছাপ নিয়ে ইমান স্মৃতি রোমন্থন করেন, ‘কিভাবে তিনি কেক ও মামল (এক ধরনের আরবীয় মিষ্টান্ন) তৈরির মাধ্যমে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে স্বাগত জানাতেন। সন্তানদের জন্য পোশাক কিনতেন। আরো কত স্মৃতি! সবই আজ সোনালি অতীত।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে আমরা এমন একটি সময় পার করছি, জীবনের অর্থই ভুলে গেছি। নিরাপত্তার অনুভূতি থেকেও বঞ্চিত। আমরা বেঁচে থাকতে ঈদ আসবে কি না, তাও জানি না। আমাদের সুস্থতা, নিরাপত্তা, আমাদের ভালো থাকা আজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ আমাদের এতটাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত করেছে যে আমরা ভুলে গিয়েছি ভালো থাকার মানে কি।’
সাংবাদিকরা গাজার আরেকজন বাস্তুচ্যুত মহিলার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যিনি নিজেকে আসমা হিজাজি বলে পরিচয় দিয়েছেন। একই রকম তাঁবুতে একই রকম অবস্থায় বসবাস করছেন। তাঁরও অভিন্ন গল্প। তিনি বললেন, ‘আগের বছরগুলোতে আমরা ঈদের জন্য অপেক্ষা করতাম এবং প্রস্তুতি নিতাম। পরিবেশটা ছিল অন্যরকম। বিশেষ আবহ বিরাজ করত গাজার সর্বত্র। আমরা বাজারে গিয়ে ঈদের পোশাক কিনতাম। আজ আমরা নিদারুণ এক করুণ পরিবেশে বসবাস করছি। ঈদ পালন করার মতো পরিস্থিতি নেই আমাদের। ওরা আমাদের ভালো থাকতে দিল না।’
যুদ্ধের সময় গাজা উপত্যকায় এটিই প্রথম ঈদ নয়। তিন বছর আগেও গাজা উপত্যকায় ঈদুল ফিতর এসেছিল বিস্ফোরণ ও বোমা হামলার মধ্যে। কিন্তু এবারের মতো এতটা ভয়াবহ নয়। গাজা উপত্যকার প্রতি ইঞ্চিতে এমন ধ্বংসযজ্ঞ এখানকার বাসিন্দারা চোখে দেখেনি। অতীতে এমন দুর্বিষহ দিন এসেছে বলে তাদের মনে নেই।
ঈদের এক সপ্তাহ আগে সাংবাদিক মুহম্মদ ইসমাইলকে দেওয়া এক পিতার মুখনিঃসৃত বক্তব্য ছিল যারপরনাই বেদনাদায়ক। যুদ্ধের কয়েক মাস থেকে ওই পিতার পুরো পরিবার তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, ‘ঈদ আসতে এক সপ্তাহ আছে। আমাদের পরিস্থিতি এত দুঃখজনক যে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের গন্তব্য অজানা। আমরা জানি না, আমাদের ভবিষ্যৎ কি এবং আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।’
ওই ভাগ্যাহত পিতা আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রিয়জন, আমাদের বাড়িঘর হারিয়েছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমরা ঈদের পরিবেশ মিস করব, হয়তো মিস করব ঈদের নামাজও। এমনকি আত্মীয়-স্বজনের একটু খোঁজখবর নেব, সেই সুযোগও নেই। যুদ্ধ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমরা উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। বাচ্চাদের ঈদ-সালামি, তাদের খুশি, তাদের উচ্ছল কণ্ঠস্বর এবং ঈদে তাদের আনন্দ এবার সত্যিই মিস করব। এই ঈদে তাদের জন্য জামাকাপড় এবং ঈদের কেক হয়তো আর কেনা হবে না।’
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকা অবলম্বনে