‘আরমান মাদক কারবারি না। কখনো কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও জড়িত ছিল না। তবে ক্যাম্পের অনেকেই ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের কারবার করে থাকে। তাদের না ধরে একজন নিরপরাধ মানুষকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। সেই থেকে পাঁচ বছর ধরে সে কারাবন্দি। তবে দেরিতে হলেও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে তার জামিনের সুযোগ হওয়ায় আমরা খুশি।’
কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর পল্লবীতে বিহারি ক্যাম্পের (মিল্লাত ক্যাম্প) বাসিন্দা আবদুর রহমান। গতকাল শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে ক্যাম্পে গেলে আলাপচারিতায় এই মুরব্বি জানালেন যে তিনি সম্পর্কে আরমানের চাচা।
ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আরমান পল্লবীর বেনারসি পল্লীর একজন সুতার কারিগর ছিলেন। তিনি কখনোই মাদক কারবারে জড়িত ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে শাহাবুদ্দিন নামে এক মাদক কারবারিকে ধরতে গিয়ে পুলিশ আরমানকে ধরে নিয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্লবী থানার একটি মাদক মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি মাদক কারবারি শাহাবুদ্দিন বিহারির পরিবর্তে আরমানকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। শুধু বাবার নামে মিল থাকায় পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে তাঁর পাঁচ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে হাইকোর্টে রিট করে একটি মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষে ‘ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন।’ পরে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল মামলার নথি তলব করে রুল জারি করেন আদালত।
গত বৃহস্পতিবার ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে আরমানের জামিনের ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আগামী ৩০ দিনের মধ্যে তাঁকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি এ ঘটনায় দায়িত্বহীনতার দায়ে সংশ্লিষ্ট চার পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) পুরো বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘আরমানের এই আটকাদেশ অবৈধ ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বেআইনিভাবে পাঁচ বছর আটকে রাখায় তিনি যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন সে জন্য ২০ লাখ টাকা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দেবেন পুলিশের আইজি ও ডিএমপি কমিশনার। আগামী ৩০ দিনের মধ্যে এই ক্ষতিপূরণ প্রদান করে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি হলফনামা আকারে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নওরোজ এম রাসেল চৌধুরী (ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল) বলেন, ‘এটা অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। আদালতও তাই বলেছেন। আর এ জন্য কোর্ট মনে করেছেন যে সংশ্লিষ্টদের একটা শাস্তি দেওয়া উচিত। আশা করি ৩০ দিনের মধ্যে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ওই ঘটনার সময় ওসি ছিলেন দাদন ফকির। তিনিসহ দুজন এএসআই ও ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তবে এ ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে দুই এএসআইয়ের দায়িত্বে অবহেলার তথ্য পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। অবশ্য সে জন্য তাঁদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা রিটের জবাব দিয়েছি। এখন আইনগতভাবে যেটা সঠিক সেটাই করা হচ্ছে।’
এদিকে আরমানকে জামিন দিতে আদালতের নির্দেশের খবরে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তাঁরা এই প্রতিবেদকের কাছে আক্ষেপ করে বলেন, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই এভাবে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়ে পুলিশ আরমানের পুরো পরিবারকেই তছনছ করে দিয়েছে। মুক্তি পাচ্ছে, ক্ষতিপূরণও হয়তো পাবে। কিন্তু ওর পরিবার যে পাঁচটি বছর বলতে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকল তার বিচার হবে কিভাবে?
ক্যাম্পে আরমানের স্ত্রী ও মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না। তবে গত বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর হাইকোর্টের সামনে আরমানের মা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এহন ছেলেরে মুক্তি দ্যান। ওর দুইটা বাচ্চা আছে। ক্ষতিপূরণের টাকাটা পাইলে বড় উপকার হবে।’ ওই সময় পাশে থাকা আরমানের স্ত্রী বলেন, ‘উনি জেলে যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে আমাকে বাসাবাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। আমার জামাইরে ছাইড়া দ্যান। যার জন্য সে সাজা খাটছে তারে ধরেন। আর আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়া দ্যান।’