বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশের আপামর জনসাধারণের মতোই হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিরাপদ ছিল না দেশের মসজিদ-মাদরাসাগুলোও। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের যেসব মাদরাসা পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়, চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া তার অন্যতম। শত্রু বাহিনীর বোমাবর্ষণে মাদরাসাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা দানেশ (রহ.) শহীদ হন।
আল্লামা দানেশ (রহ.) ১৯০৭ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার চরম্বায় জন্মলাভ করেন এবং এখানেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
এরপর রাঙ্গুনিয়ার খণ্ডলিয়াপাড়া মাদরাসা ও জামিয়া ইসলামিয়া জিরিতে পাঠগ্রহণ করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে যান। সেখান থেকে ফিরে মিয়ানমারের আকিয়াবে অবস্থিত পাথরকিল্লা মাদরাসায় কর্মজীবন শুরু করেন। পাঁচ বছর পাঠদানের পর যোগ দেন সাতকানিয়া আলিয়া মাদরাসায়। এই মাদরাসায় তিনি ১৬-১৭ বছর পাঠদান করেন। অতঃপর পটিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আজিজুল হক (রহ.)-এর অনুরোধে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়াতে যোগদান করেন। তিনি পটিয়ায় যোগদান করার কয়েক বছরের পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে আরো অনেকের মতো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ফলে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ওপর হানাদার বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি পড়ে। তাদের হাত থেকে সম্প্রচারকেন্দ্রটি রক্ষা করতে মেজর জিয়া পটিয়া মাদরাসায় আশ্রয় নেন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানান। পটিয়া মাদরাসার মেহমানখানা ছেড়ে দেন তাঁদের জন্য। সেখানে তাঁরা অস্থায়ী বেতারকেন্দ্রটি পুনরায় চালু করেন। তবে হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে তাঁরা দ্রুততম সময়ে পটিয়া মাদরাসা ত্যাগ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাওয়ার পরও মাদরাসাটির ওপর খড়্গ নেমে আসে। এপ্রিল মাসেই পাকিস্তানি বিমান বাহিনী মাদরাসায় বোম্বিং করে। বোমা হামলায় পুকুরপাড়ে অবস্থিত একটি ভবন পুরোপুরি ধসে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্যান্য মাদরাসার মতো পটিয়া মাদরাসাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন মাদরাসার মহাপরিচালক হাজি ইউনুস (রহ.) হজযাত্রায় মক্কা অবস্থান করছিলেন। অন্য শিক্ষকদের মতো আল্লামা দানেশ (রহ.) বাড়ি চলেন আসেন। কিন্তু স্বপ্নযোগে মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও আল্লামা দানেশ (রহ.)-এর শিক্ষক মুফতি আজিজুল হক (রহ.) বলেন, সবাই মাদরাসা ছেড়ে চলে গেল! তুমিও চলে গেলে। কে রক্ষা করবে আমার এই ইলমে নববীর বাগান? প্রিয় শিক্ষকের এই আক্ষেপ তাঁকে বাড়িতে স্থির থাকতে দিল না। তিনি ঘুম থেকে উঠেই মাদরাসায় ছুটে গেলেন। তিনি মাদরাসায় ফেরার কিছু দিনের মধ্যেই হানাদার বাহিনী বোমা হামলা করল এবং তিনি শহীদ হলেন। জনপ্রিয় এই শিক্ষককে জ্ঞানের ‘রাজি’ বলা হতো। এ সময় অপর শিক্ষক কারি জেবুল হাসানের এক মেহমানও শহীদ হন। আহত হন আরো বহু লোক। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর হামলায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘এদারাতুল মাআরিফ’-এর অফিস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর পরিচালক মাওলানা হারুন ইসলামাবাদীর বহু মূল্যবান পাণ্ডুলিপি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আল্লামা দানেশ (রহ.) এপ্রিল ১৯৭১-এর কোনো এক শুক্রবার শহীদ হন। রাজঘাটা মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল গনি তাঁর পরিবারকে সংবাদ দেন। সংবাদ পেয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান বদিউল আলমসহ পরিবারের ১০-১২ জনের একটি দল পটিয়া এসে তাঁর লাশ লোহাগাড়ায় নিয়ে যান। মুক্তিযুদ্ধের বিপত্সংকুল অবস্থার মধ্যেও হাজার হাজার মানুষ তার জানাজা পড়তে হাজির হন। আল্লামা দানেশ (রহ.) ছিলেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা হাজি ইউনুস (রহ.)-এর খলিফা। আল্লামা দানেশের শাহাদাতের সংবাদ শুনে তিনি বলেন, ‘তাঁর ইন্তেকালে মাদরাসার চার ভাগের তিন ভাগই যেন চলে গেল। ’
তথ্যঋণ : আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে