Sunday, October 1, 2023
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামমে দিবসের তাৎপর্য কি আমরা বুঝতে পারি?

মে দিবসের তাৎপর্য কি আমরা বুঝতে পারি?

আনু মুহাম্মদ 

মজুরি শ্রমিকের জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে পুঁজিবাদের জন্ম ও বিকাশের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। মজুরি শ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া পুঁজিবাদের অস্তিত্ব ও বিস্তার সম্ভব হয় না। সেজন্য ইউরোপে শিল্পবিপ্লব কালে একদিকে যেমন পুঁজিপতি একটি শ্রেণি হিসাবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে তেমনি তৈরি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি। একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় একই চিত্র ছিল। কাজের সময় কিংবা মজুরির তখন ঠিক ছিল না। ক্রমেই নারী-শিশুসহ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় জীবন পরিবর্তনের জন্য অসংখ্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তৈরি হয়, সংগঠন গড়ে ওঠে। উনিশ শতকের ৬০/৭০/৮০ দশকের এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে তিন লক্ষাধিক শ্রমিকের ধর্মঘট চলাকালে শিকাগো শহরের বড় সমাবেশে হামলা হয়। গুলিতে নিহত হন শ্রমিকরা, পরে আবার প্রহসনমূলক বিচারে শ্রমিক সংগঠকদেরই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এ জীবনদান বৃথা যায়নি। একসময়ে যে দাবিকে বলা হয়েছে উন্নয়নবিরোধী, সন্ত্রাসী-ক্রমে সারা বিশ্ব সেই দাবিই গ্রহণ করেছে, মে দিবস পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখনো সেই ইতিহাস স্মরণ করতে ভয় পায়। তাই সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে এটি পালিত হয় না। তারা শ্রম দিবস পালন করে ৪ সেপ্টেম্বর!

বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির গঠনের পরিবর্তন। বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে ’৮০ দশক থেকে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। ২০০২ সালে বন্ধ হয়েছে আদমজী জুট মিল, গত কয় বছরে বাকি সব জুট মিল, চিনিকল। ’৮০ দশক পর্যন্ত এ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকরাই ছিল দেশের শিল্পশ্রমিকদের প্রধান সংগঠিত অংশ। সরকার নির্বিশেষে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ করার প্রক্রিয়াটি শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ব্যক্তি দখলে নেওয়ার প্রক্রিয়াই নয়, এটি একইসঙ্গে শিল্পশ্রমিকদের সংগঠিত শক্তিকে ভেঙে দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অংশ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে শিল্প খাতের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প খাতের অবস্থ’ান খুবই প্রান্তিক। একই কারণে ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যাও তুলনায় অনেক কম। রপ্তানিমুখী খাত হিসাবে গার্মেন্টস শিল্প খাতের মধ্যে এখন প্রাধান্যে। শিল্প খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক এ খাতেই নিয়োজিত। এ খাত অনেক বেশি আলোচিত হলেও এখানেও ইউনিয়নের সংখ্যা হাতেগোনা, অন্যান্য সংগঠনের অবস্থাও খুবই দুর্বল।

অন্যদিকে গত কয়েক দশকে একই অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে উদ্ভূত হয়েছে কয়েক হাজার দখলদার চোরাই কোটিপতি। তাদের রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছে মাফিয়া রাষ্ট্র। উৎপাদনশীল প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং বিকশিত করার চাইতে অতিশোষণ, দখল, লুণ্ঠন ও পাচারের মধ্য দিয়ে দ্রুত সম্পদ কেন্দ্রীভবন এবং তা নিশ্চিত করতে সর্বজনের গণতান্ত্রিক অধিকার চুরমার করাই তাদের প্রধান কাজ। বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রধানত তাদের নিয়ন্ত্রণে। সেই কারণে জনগণের বৃহত্তম অংশ শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত-বেশিরভাগ শিল্প-কারখানায় কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম বাঁচার মতো মজুরি, ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস, নিয়োগপত্র, সাপ্তাহিক ছুটি, কাজ ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা-এসবের অধিকাংশই অনুপস্থিত। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা এখনো অব্যাহত নিপীড়ন ও প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ধরপাকড়, হামলা, নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। যতগুলো আছে, তার মধ্যে পোষা ইউনিয়নেরই আধিক্য দেখা যায়।

গার্মেন্ট শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির গঠনে লিঙ্গীয় পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হয়েছে। এ খাতে অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। এর বাইরেও বিভিন্ন পেশাতেই নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারী ক্ষমতায়নের বহু গল্প শুনি আমরা, কিন্তু প্রতিদিনের খবরের কাগজে এ শ্রমজীবী নারীর নিরাপত্তাহীনতা, খুন, ধর্ষণ, হয়রানির খবর আসে। অব্যাহত বঞ্চনা ও নিপীড়ন মোকাবিলা করতে গিয়ে নারীশ্রমিক এক নতুন প্রতিবাদী সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

পুঁজির বর্তমান চাহিদা ও বিন্যাসের কারণে বর্তমানে প্রায় সব খাতেই অস্থায়ী, দিনভিত্তিক, খণ্ডকালীন, চুক্তিভিত্তিক, ইনফর্মাল বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই এখন ক্রমবর্ধমান। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ, একেবারেই অসংগঠিত এবং চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টাই তাদের জীবন। অনলাইন শ্রমিকের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে, যাদের অনিশ্চয়তা আরও বেশি। মে দিবসের মূল যে দাবি ৮ ঘণ্টা কাজ করে বাঁচার মতো মজুরি, তা থেকে বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শ্রমিক-মেহনতি মানুষসহ শিক্ষিত মজুরেরাও অনেক দূরে।

সংগঠিত হওয়ার সুযোগ শিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের জন্যও খুবই ক্ষীণ। সে কারণে ব্যাংক, বিমা, মিডিয়া, এনজিও, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, অনলাইন খাত কোথাও কাজের ও আয়ের নিরাপত্তা দেখা যায় না। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষদের যে কোনো সময় ছাঁটাই এবং তাদের ওপর অন্যায়-অবিচারের প্রতিকারের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। সরকার সর্বত্রই নীরব দর্শক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখা প্রশ্নে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো এতটা নিষ্ক্রিয় কমই দেখা যায়।

দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্যে আছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তাদের জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছাড়াই বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপন্ন (জিডিপি) আর গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পরিসংখ্যানের চাতুর্য আর গড় হিসাবের প্রতারণায় ঢাকা থাকছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের নির্মমতা। কৃষিতে কৃষকদের, গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিকদের আর প্রবাসী শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির উঁচু হার। অন্যদিকে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে গেছে। পরিবহণ ব্যয়, বাসাভাড়া বেড়েছে। করোনা-পরবর্তী বছরে কাজ ও আয়ের বিপর্যয়ে পড়েছে বেশিরভাগ মানুষ। বিশ্বরেকর্ড করা সব প্রকল্প ব্যয়ের অর্থ জোগাতে সরকারের সর্বব্যাপী সম্পদ সন্ধানে কর ফি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, জিনিসপত্রের অনিয়ন্ত্রিত দামবৃদ্ধিতে প্রকৃত আয় কমে গেছে বেশিরভাগ মানুষের। দেশের মানুষের জীবিকা-সংস্থানকে উচ্ছেদ করে, নদীব্যবস্থা আর বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদ বিকাশ প্রক্রিয়ায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে; কিন্তু স্থায়ী স্থিতিশীল পরিবেশসম্মত, সম্মানজনক কাজের সুযোগ বাড়েনি।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজির দ্রুত সংবর্ধনের পাশাপাশি শ্রমের সঙ্গে যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ে মে দিবসের কথাই আসে বারবার। অব্যাহত প্রান্তিকীকরণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তাদের বিকশিত হওয়ার তাগিদ দেয় মে দিবস। এ লড়াইয়ের দুর্বলতা থাকলে তা শ্রমিক শ্রেণিকে কতটা হীন অবস্থায় ফেলতে পারে, বাংলাদেশ তার দৃষ্টান্ত। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় যে শ্রমিক গণহত্যা সংঘটিত হলো, বিশ্বের বৃহত্তম কারখানায় এরকম ধসের পরও দেশে নিরাপত্তা, মজুরি ও সংগঠনের অধিকারের যে হাল তা এ দুর্বলতারই প্রকাশ। এ দুর্বলতার কারণেই লুটেরা দেশি চোরাই কোটিপতি ও আন্তর্জাতিক মুনাফাখোরদের সীমাহীন লোভ ও তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ফলাফল হিসাবে বারবার কারখানা পরিণত হয় গণকবরে। রূপগঞ্জে, সীতাকুণ্ডে পুড়ে নিহত হলেন শতাধিক শ্রমজীবী মানুষ, পুরান ঢাকাসহ নানা স্থানে বিস্ফোরণ, ধস, আগুনের প্রধান শিকার তারাই। নির্মাণ শ্রমিক নিহত হচ্ছেন নিয়মিত। এগুলোর কোনো প্রতিকার নেই, আর ঘটবে না এরকম অবস্থা সৃষ্টির কোনো চেষ্টাও নেই। সম্প্রতি বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্বহারা হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষই। সেখানে কতিপয় গোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসাবেই এসব আগুনের ঘটনা, এটি ভাবার যুক্তিসংগত কারণ আছে।

বিশ্বের সব অঞ্চলেই পুঁজির ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে শ্রমশক্তি বিক্রির মানুষ অর্থাৎ মজুরেরও বিস্তার ঘটে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুদূর। সেজন্য শুধু শিল্প খাতের মধ্যেই শ্রমিক পরিচয় সীমাবদ্ধ রাখলে পুঁজির আধিপত্য ও ক্রিয়ার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। প্রযুক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তি বিক্রেতাদের মধ্যে বহু ধরন তৈরি হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মধ্যবিত্ত, কিন্তু সর্বক্ষণ অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত ডিগ্রিপ্রাপ্ত এখন অনেকেই। কাজেই মে দিবস যাদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা দেয়, তারাই সমাজের ৯৯ শতাংশ।

আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments