লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ছাড়া নিয়ে কম নাটক হয়নি। ১০ দিন পর সে নাটকের অবসান ঘটেছে। মেসি ন্যু ক্যাম্পেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব নিয়ে সংবাদমাধ্যম গোলডটকমের স্পোর্টস রিপোর্টার রুবেন উরিয়াকে শুক্রবার একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিয়েছেন মেসি। যেখানে নানান বিষয় উঠে এসেছে। মেসির দেয়া সেই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো-
গোল: নীরবতা ভাঙতে কেন এত সময় নিলেন?
মেসি: প্রথমত, লিসবনের হার হজম করা খুব কঠিন ছিল। আমরা জানতাম বায়ার্ন মিউনিখ অনেক শক্ত দল। কিন্তু তাই আমাদের শেষটা এমন হবে, যা বার্সেলোনা শহর ও ক্লাবে খারাপ ইমেজ বয়ে আনবে…আমরা বাজে ইমেজ বয়ে এনেছি।এসব কারণে আমি একটু সময় নিয়ে সব খোলাসা করতে চেয়েছিলাম।
গোল: বার্সাকে কেন বলেছিলেন যে ক্লাব ছাড়তে চান?
মেসি: ক্লাব ও প্রেসিডেন্টকে আমি যাওয়ার কথা বলেছিলাম। ওদের সেটা সারা বছরই বলে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল, আলাদা হওয়ার এটাই প্রকৃত সময়। মনে হয়েছিল, ক্লাবের আরো বেশি তরুণ খেলোয়াড় প্রয়োজন। ভেবেছিলাম, বার্সেলোনায় আমার সময় শেষ। খুব খারাপ লাগছিল, কারণ সবসময়ই বলে এসেছি বার্সায় ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই। আমার জন্য বছরটা অনেক কঠিন ছিল- ট্রেনিং, মাঠ, ড্রেসিংরুম সবকিছুই। এরপর একটা সময় এলো যখন নতুন লক্ষ্য নিয়ে ভাবতে লাগলাম। এমন নয় যে বায়ার্নের কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভাবনাটা এসেছে। অনেক আগে থেকেই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটা। ব্যাপারটা প্রেসিডেন্টকে জানাই। প্রেসিডেন্ট সবসময়ই বলে এসেছে, মৌসুম শেষে চাইলেই আমি ক্লাব ছাড়তে পারি অথবা থেকে যেতে পারি। কিন্তু পরিশেষে তিনি কথা রাখেননি।
গোল: কখনো একাকী লেগেছে?
মেসি: না, আমার একাকীত্ব বোধ হয়নি। কিছু মানুষ সবসময়ই আমার পাশে ছিল। আমার মানসিক শক্তির জন্য তাদের সঙ্গই যথেষ্ট। কিন্তু লোকের কিছু কথায় আমি কষ্ট পাই। সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেকেই বার্সেলোনায় আমার নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এবং আরো কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে যা আমার প্রাপ্য নয়। তবে এ বিষয়গুলো আমার সামনে ফুটবল দুনিয়ার মন্দ লোকদের মুখোশ উন্মোচিত করে দিয়েছে। আমি বার্সেলোনায় থাকি না থাকি, ক্লাবটির প্রতি ভালোবাসা কখনোই কমবে না।
গোল: বার্সার ২০ বছরের ক্যারিয়ারে কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে?
মেসি: ক্লাবকে সবকিছুর আগে অগ্রাধিকার দিয়েছি। বার্সার ছাড়ার কম সুযোগ পাইনি? টাকার কথা বলছেন? প্রতি বছরই বার্সা ছাড়া এবং বার্সেলোনায় চেয়ে অন্য ক্লাবে বেশি আয়ের সুযোগ ছিল আমার। কিন্তু আমি সর্বদা বলে এসেছি, এটাই আমার বাড়ি। এর চেয়ে ভালো ঠিকানা বেছে নেয়া আমার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, আমার একটা পরিবর্তন, নতুন লক্ষ্য এবং নতুন কিছু প্রয়োজন।
গোল: বার্সেলোনার ২০ বছরের জীবন ছেড়ে যাওয়া কঠিন, মনে হয় আপনি এখানেই থাকবেন শেষ পর্যন্ত…
মেসি: আমি সবসময়ই বলেছি, এখানে ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই। আমি যা চাই তা হলো একটা উইনিং প্রজেক্ট। ক্লাবের হয়ে শিরোপা জেতা। কিন্তু সত্যিটা হলো অনেকদিন ধরে ক্লাবের কোনো উইনিং প্রজেক্ট নেই। আমি সর্বদা ক্লাব ও আমার পরিবারের ভালোটা চিন্তা করি।
গোল: পরিবারকে বার্সা ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর কী ঘটে?
মেসি: যখন আমি ব্যাপারটা তাদের জানালাম, সবাই কাঁদতে শুরু করলো। ওটা ছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আমার ছেলেরা বার্সেলোনা ছাড়তে চায়নি, ওরা চায়নি স্কুল পাল্টাতে।
গোল: ওরা কি খবরটা টিভিতে দেখেছে, কিংবা আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে?
মেসি: এটা তাদের জন্য কষ্টের ব্যাপার। আমি কী চাই, আমার অনুভূতি কী তাদের পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমাকে সমর্থন জানিয়েছিল।
গোল: কিন্তু পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তো মাতেও
মেসি: (হেসে), হ্যাঁ, মাতেও এখনো ছোট। অন্য জায়গায় যাওয়ার মানেটা সে বুঝতে পারেনি। থিয়াগো বড়। সে খরবটা টিভিতে শুনে কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল এবং জিজ্ঞেসও করেছিল আমাকে। আমাদের বাধ্য হয়ে চলে যাওয়া, তার নতুন স্কুল জীবনে পা রাখা বা নতুন বন্ধু তৈরি করা- এসব নিয়ে আমি তাকে কিছু বুঝতে দিতে চাইনি। সে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলল, ‘যেও না।’ এটা আসলেই কষ্টদায়ক ছিল।
গোল: আপনি বার্সেলোনায় থাকছেন, এটা কি বার্সা সমর্থকদের জন্য কোনো আশাব্যাঞ্জক বার্তা?
মেসি: বরাবরের মতোই আমি আমার সেরাটা দিতে যাচ্ছি। লক্ষ্য পূরণে আমরা সর্বোচ্চটাই দেবো। এ বছরটা আমার খারাপ কেটেছে। কিন্তু যেসব মানুষ করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্বজন ও অনেক কিছু হারিয়েছে তাদের তুলনায় তো আমি ভালো! আশা করি, নিজের সেরাটা দিয়ে সেসব মানুষকে বিজয় উৎসর্গ করতে পারবো, যারা আমাদের পাশে ছিল।
গোল: বুরোফ্যাক্সের মাধ্যমে কেন সিদ্ধান্তটা জানালেন?
মেসি: আমি যে ক্লাব ছাড়তে চাই সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর উদ্দেশ্যেই বুরোফ্যাক্স করা। বছর জুড়েই আমি বার্সা সভাপতিকে বলেছি যে ক্লাব ছাড়তে চাই। কিন্তু তিনি সবসময়ই বলছেন- আমরা আলোচনায় বসবো। এখন না। এটা, সেটা। আদতে কিছুই না। এসব কারণেই বুরোফ্যাক্স পাঠানো। তাদের মনে করিয়ে দেয়া যে আমি এখন ফ্রি। বার্সায় যে এক বছর বাকি আছে, সেটি চালিয়ে যেতে চাই না। ক্লাবের বিরুদ্ধে যাওয়া কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বুরোফ্যাক্স করিনি।
গোল: বুরোফ্যাক্স না করলে, হয়তো কেউ আপনার বিষয়টি আমলে নিতো না?
মেসি: একদম তাই। আমি যদি বুরোফ্যাক্স না করতাম, তাহলে ব্যাপারটা এমন হতো যে কিছুই ঘটেনি। আমাকে চুক্তির বাকি এক বছর এভাবেই কাটাতে হতো। ওরা যেটা বলেছে, আমি ১০ই জুনের আগে ওদের কিছু জানাইনি। কিন্তু তখন আমরা সব প্রতিযোগিতার মাঝপথে ছিলাম। প্রেসিডেন্ট সবসময় আমাকে বলে এসেছে মৌসুম শেষে থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত তোমার। তিনি কখনো কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি। বুরোফ্যাক্স করার মাধ্যমে ক্লাব কর্তাদের আমি জানিয়েছি, প্রেসিডেন্ট তার কথা রাখেননি। একই সঙ্গে সংঘাতও এড়িয়েছি। কারণ আমি কখনোই ক্লাবের সঙ্গে ওসবে জড়াতে চাইনি।