পৃথিবীর বুকে চিরসত্য একটি কথা ‘মৃত্যু’, যা কারো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। জন্মের পর থেকে মানুষ মৃত্যুর দিকে ধাবমান। সেই অনন্ত জীবনের পরিণতি নির্ভর করে এই অস্থায়ী জীবনের কর্মের ওপর। কিন্তু এই চিরসত্য থেকে আমরা এমনভাবে ঘুমিয়ে আছি।
কেন যেন আমাকে কোনো দিন মৃত্যু গ্রাস করবে না—এমন স্বপ্নের জাল বুনছি যেন আমি অবিচ্ছেদ্য আয়ুর মলিক। আকাশচুম্বী আশা ও দুনিয়া উপার্জনের ক্রমাগত চেষ্টাই আমার দিন গুজরান। আর স্বপ্নচূড়া সৌধ চুরমার করে একদিন হাজির হয় অনিবার্য মৃত্যু। যাদের জীবন সুন্দর, তাদের মৃত্যু সুন্দর। আর যাদের জীবন অসুন্দর, তাদের মৃত্যুও হবে অসুন্দর। সুতরাং আমাকে এখনই ভাবতে হবে আমার পথ চলা কোনদিকে। আমি কি নন্দিত হবো, না নিন্দিত হবো?
হজরত ওমর (রা.) বলেন, প্রতিদিন ঘোষণা করা হয়, অমুক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে, আর অমুক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে প্রায়দিন আমাদের কানে মৃত্যুর আওয়াজ ভেসে আসে। একদিন নিশ্চয়ই এ কথা ঘোষণা করা হবে, ওমর মৃত্যুবরণ করেছে। (রিসালাতুল মুসতারসিদিন)
বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ
দুনিয়ার ভোগ-বিলাস আর রংতামাশা থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য মৃত্যুচিন্তা অপরিহার্য। সে জন্য রাসুল (সা.) সাহাবাদের মৃত্যুচিন্তার তাগিদ দিয়েছেন। আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো একসময় রাসুল (সা.) নামাজে (জানাজার) এসে দেখেন যে কিছু লোক হাসাহাসি করছে। তিনি বললেন, ওহে, তোমরা যদি জীবনের স্বাদ ছিন্নকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করতে, তাহলে আমি তোমাদের যে অবস্থায় দেখছি অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকতে। তোমরা জীবনের স্বাদ ছিন্নকারী মৃত্যুকে খুব বেশি স্মরণ কোরো। কেননা কবর প্রতিদিন দুনিয়াবাসীকে সম্বোধন করে বলতে থাকে, আমি প্রবাসী মুসাফিরের বাড়ি, আমি নির্জন কুটির, আমি মাটির ঘর, আমি পোকা-মাকড় ও কীট-পতঙ্গের আস্তানা। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৬০)
সৎ জীবনের পথ দেখায়
কোনো মানুষ যদি প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে চিন্তা করে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন কেমন হবে তা নিয়ে ভাবতে থাকে, তাহলে তার জীবনের গতিপথ অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রিয় বন্ধু! তুমি কি জানো না বাজারে হয়তো সেই কাফনের কাপড়ও পৌঁছে গেছে, যা দিয়ে তোমাকে পেঁচিয়ে কবরস্থ করা হবে। যে খাটে করে তোমাকে বহন করা হবে সে খাটও প্রস্তুত তোমার অপেক্ষায়! কিন্তু তুমি সেই মৃত্যু থেকে বেঘোর ঘুমিয়ে আছো।
রাসুল (সা.) সাহাবাদের মৃত্যু এবং আমাদের জীবন, এই দুটোকে উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, একদিন আমাদের (বোঝানোর) উদ্দেশ্যে রাসুল (সা.) একটি বর্গাকৃতির চতুর্ভুজ আঁকলেন, তারপর এর মাঝ বরাবর একটি লম্বা রেখা টানলেন, তারপর একটি লম্বা রেখা টানলেন চতুর্ভুজের বাইরে দিয়ে, তারপর মাঝের লম্বা রেখার চারদিকে বেশ কিছু রেখা টানলেন এবং বললেন, এটি হলো আদম-সন্তান এবং বেষ্টনী হলো তার জীবনকালের সীমা, যা তাকে বেষ্টন করে রেখেছে। মাঝের লম্বা রেখাটি হলো মানুষ, এর চারপাশের রেখাগুলো হলো তার বিপদাপদ। এর একটি হতে সে মুক্তি পেলে অন্যটি তাকে দংশন করে। আর বাইরের রেখাটি হলো তার কামনা-বাসনা। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৪৫৪)
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) দুটি নুড়ি পাথর ছুড়ে দিয়ে বললেন, এটা এবং ওটা কিসের মতো, তোমরা জান কি? সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুল ভালো জানেন। তিনি বলেলন, এটা (দূরেরটা) হলো মানুষের কামনা-বাসনা এবং এটা (কাছেরটা) হলো তার হায়াত। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৮৭০)
কবর জিয়ারতের নির্দেশ
আমাদের মাঝে যেন মৃত্যুচিন্তা আসে সে জন্য রাসুল (সা.) উম্মতকে বিশেষভাবে কবর জিয়ারতের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর জিয়ারত কোরো। কেননা তা পরকালের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ১০৫৪)
মৃত্যুচিন্তা ইখলাস জোগায়
মৃত্যুচিন্তা অন্তরে ইখলাস নিয়ে আসতে সাহায্য করে। বান্দাকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আমল করতে উৎসাহিত করে। তখন আর লোক দেখানো মনোভাব থাকবে না। কারণ সে যেকোনো কাজ করার পূর্বে এ কথা চিন্তা করবে যে হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ আমল; তখন সে সযত্নে প্রভুর সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমল করবে। মরণের ভাবনা তাকে বাধ্য করবে আল্লাহর জন্য ইবাদত করতে। আবু আইয়ুব (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে সংক্ষেপে কিছু শিক্ষা দিন। তিনি বলেন, যখন তুমি তোমার নামাজে দাঁড়াবে, তখন এমনভাবে নামাজ আদায় করো, যেন এটাই তোমার শেষ নামাজ। তুমি এমন কথা বলো না, যার জন্য তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। আর মানুষের হাতে যা আছে তা থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হও। (সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস : ৪১৭১)
কোনো মানুষ যখন মৃত্যুর চিন্তায় চিন্তিত হবে, তখন সে ভালো পথে হাঁটার চেষ্টা করবে। অসৎ কর্মের দিকে পা বাড়াবে না। আল্লাহর প্রতি অভিমুখী হবে। যেসব জিনিস অন্তরকে কলুষিত করে তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। সে জন্য প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে নিয়ে চিন্তা করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফিক দান করুন।