Saturday, July 27, 2024
spot_img
Homeনির্বাচিত কলামমূল সমস্যায় অবহেলা, চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা

মূল সমস্যায় অবহেলা, চতুর্দিকে বিশৃঙ্খলা

সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমানভাবে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে অনেকটা একতরফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন।

সে নির্বাচনে দেশের বড় একটি দল অংশগ্রহণ না করলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের মধ্যে আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন।

যেখানে সাধারণ সময়ে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে একজন চেয়ারম্যান পদে ছয়-সাতজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা, সেখানে তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১০০ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনের আগে-পরে মিলে মোট সহিংসতাজনিত কারণে ৩৯টি প্রাণ ঝরে গেছে। তৃতীয় ধাপেও এ ধারার পরিবর্তন হয়নি।

পত্রিকার খবর অনুযায়ী, তখন বিজিবি সদস্যসহ ৯ জন মারা গেছেন। এসব খুনের কোনো বিচার হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন এসব সহিংসতা ও খুনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও আশ্চর্যজনকভাবে এর দায় নিতে নারাজ। ফলে যারা এমন খুনোখুনিতে মারা যাচ্ছেন, তাদের দায় কেউ নিচ্ছেন না। মানুষের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্যে নির্বাচনি সহিংসতাকে হালকা করে দেখানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ইউপি নির্বাচন নিয়ে একটু ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে।’

তবে ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলা ও খুনোখুনির চেয়ে আরও বড় সমস্য হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমনভাবে হবে, সেই সংকটের সমাধান না হওয়া। কারণ, গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) যেভাবে হয়েছে, তাতে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুটি নির্বাচন নতুন করে প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়।

এ সমস্যার সমাধান করতে হলে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যাতে করে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, সেজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি দল চাইলে সহজে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। জাতীয় সংসদে সরকারি দলের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। সরকার উদ্যোগ নিলে সংসদে একটি বিল পাশ করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেহেতু বাতিল করা হয়েছে, সেহেতু এমন সরকারের ভিন্ন নাম দেওয়া যেতে পারে। সরকার চাইলে এর নাম ‘তদারকি সরকার’, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’, ‘নির্বাচন দেখভালকারী সরকার’ বা অন্য কোনো পছন্দসই নাম দিতে পারে। তবে এ সমস্যার সমাধানের বিষয়টিকে অবহেলা করে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্মাণ ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করা যাবে না। কারণ, সরকারই যদি গঠিত হয় অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে, তাহলে সে সরকারের পক্ষে জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। সম্ভব হবে না বিশৃঙ্খলা নিরসন করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা। পরিবর্তে, জনসমর্থন না থাকা এমপি-মন্ত্রীরা জনবান্ধব কাজ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাবেন। তাদের কথাবার্তায় একটা লাগামহীনতার ভাব আসবে, যা অতিসম্প্রতি সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

কোনো সরকার উপর্যুপরি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হতে থাকলে এর প্রভাব সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে। এ কারণেই দেশে প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নয়নের চাকচিক্য দিয়ে এ বিশৃঙ্খলা ঢাকার চেষ্টা সফল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। নির্বাচনি দুর্নীতিতে জড়িতদের কোনো শাস্তি না হওয়ায় তারা বারবার নির্বাচনে দুর্নীতি করতে ভয় পাচ্ছে না। ফলে জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকার-সব রকম নির্বাচনেই অনিয়ম ও দুর্নীতির চর্চা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণেও নেওয়া হচ্ছে না কোনো বিশেষ উদ্যোগ।

পঞ্চাশ বছরেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থীবান্ধব ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে পারেনি। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করে প্রশংসিত হয়েছে। আবার এমসিকিউ পরীক্ষার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করে মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ, কেবল এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা যায় না। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছরও কেবল এমসিকিউ পদ্ধতিতে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়।

এতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরীক্ষার্থীদের শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়। আবার ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে সেখানেও পরীক্ষার্থীদের সব রকম প্রত্যাশিত সহায়তা দিতে পারেনি। এ পরীক্ষা পদ্ধতিরও নানা রকম সমালোচনা হয়েছে।

তবে এর চেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা ঘটেছে আর্থিক ক্ষেত্রে। মানি লন্ডারিং, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক লুটপাট ও ব্রেইন ড্রেইন মাত্রারিক্তি হারে বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে অগণতান্ত্রিকতা ও রাজনীতিতে আমলা ও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অন্যান্য খাতের চেয়ে অধিকতর বিশৃঙ্খল। এ খাতে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। করোনাকালীন এটি কেবল সুশীল সমাজ নয়, সাধারণ মানুষও সহজভাবে বুঝতে পেরেছেন। অবৈধ মুনাফা করার জন্য করোনামুক্ততার সনদ বিক্রয় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাতে ওই দুঃসময়ে যে কত রকম দুর্নীতি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে পদে পদে দুর্নীতি।

সরকারি-বেসরকারি অফিসের নিয়োগব্যবস্থায় এখন কোনো শৃঙ্খলা নেই। যোগ্য পদে যোগ্য লোক নিয়োগ না করায় অফিস-আদালতে পেশাদারিত্ব কমছে এবং বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষক নিয়োগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবীরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৬ সালে ১৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এর গবেষণা প্রতিবেদনে প্রভাষক নিয়োগে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের তথ্য উপস্থাপন করেছে। গবেষণার ক্ষেত্রেও ধরা পড়ছে চৌর্যবৃত্তি ও প্লেজিয়ারিজম।

এ কারণে অনেক শিক্ষককে শাস্তিও প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও নানা রকম একাডেমিক দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একজনের নামে অন্যজন প্রবন্ধ লিখে প্রকাশ করে দেওয়া। একজনের থিসিস অন্যজনে লিখে দেওয়াসহ আরও নানা রকম পক্ষপাতিত্ব। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় মানের অবনমন ঘটেছে। বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর প্রকাশিত মানের সূচকে খুঁজে পেতে কষ্ট হচ্ছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ খ্যাতিমান একাডেমিকের দুর্ভিক্ষ চলছে। নতুন শিক্ষকদের অনেককেই একাডেমিক কাজের চেয়ে প্রশাসনিক কাজে অধিক মনোযোগী হতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যে ব্যতিক্রম নেই এমন নয়।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে যারা ভালো করছেন, তাদের বেশিরভাগই নিজের চেষ্টায় উঠে আসছেন। প্রতিষ্ঠানের অবদান সেখানে গৌণ।

এভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও প্রশাসনের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বিশৃঙ্খলা। এ বিশৃঙ্খলা সহজে দূর করা যাবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যদি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে, তাহলে ক্রমান্বয়ে এ বিশৃঙ্খলা হ্রাস করা যেতে পারে। কারণ, সরকার নিজেই যদি নৈতিকভাবে দুর্বল এবং বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়, তাহলে সে সরকারের পক্ষে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করা সম্ভব হবে না। এসব দিক বিবেচনা করে দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য সবার আগে যে কাজটি করা দরকার, তা হলো অবিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় একটি সরকারের অধিষ্ঠান। আর এজন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে দুর্নীতিমুক্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। প্রচলিত পদ্ধতিতে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে মহামান্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে যে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় না, সে বিষয়টি একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন হলেও ইসি গঠনের জন্য সাংবিধানিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার কোনো সরকারি উদ্যোগ বা ইচ্ছা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

সেই সঙ্গে সাংবিধানিক আইন করে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করারও কোনো ইচ্ছা সরকারের আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ না দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা হলে দেশ বিরাজমান বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। পরিবর্তে, চলমান বিশৃঙ্খলা অধিকতর প্রসারিত হয়ে দেশকে আরও অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাবে।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments