আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ
এই পথে মোর চলে যেতেন নূর-নবী হজরত
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতায় পবিত্র মক্কা-মদিনার প্রতি মুসলমানের আবেগ ও অনুভূতি দারুণভাবে ব্যক্ত হয়েছে। মুসলমানের হৃদয়পটে মক্কা-মদিনার প্রতি এই ভালোবাসা ও আবেগ আজন্ম। মক্কা-মদিনা জিয়ারতের স্বপ্ন নিয়েই বেড়ে ওঠে প্রতিটি মুসলিম শিশু। কেননা পবিত্র দুই নগরীর ধুলাবালিতে মিশে আছে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিরাশি। শুধু মহানবী (সা.) নয়, আরো অসংখ্য নবী-রাসুল, সাহাবায়ে কেরাম, পরিবারের পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ভূমির সঙ্গে।
হজ ঈমানের দাবি : নবী-রাসুলদের স্মৃতিধন্য পবিত্র ভূমির প্রতি মুমিনের এই ভালোবাসা তাদের ঈমানেরই বহিঃপ্রকাশ। হজের মাধ্যমে মুমিনের ঈমান সজীব হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে এবং সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৭-২৮)
‘তাদের জন্য কল্যাণময় স্থান’-এর ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, স্থানগুলোর দ্বিনি উপকার হলো এতে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
পবিত্র মক্কা ও মদিনার প্রতি মুমিনের অকৃত্রিম ভালোবাসা তারা তাদের নবীর কাছ থেকেই লাভ করেছে। নবী কারিম (সা.) প্রিয় জন্মভূমিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘ভূখণ্ড হিসেবে তুমি কতই না উত্তম, আমার কাছে তুমি কতই না প্রিয়। যদি আমার স্বজাতি আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি কিছুতেই অন্যত্র বসবাস করতাম না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৯২৬)
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দৃষ্টান্ত
হজযাত্রীদের যাত্রা সহজ করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নতুন কিছু নয়। বরং খোলাফায়ে রাশেদা থেকে শুরু করে উসমানীয় খেলাফত পর্যন্ত সব শাসকই হজযাত্রীদের সেবায় সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষত মক্কা-মদিনার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যাঁদের হাতে থাকত, তাঁরা হাজিদের আপ্যায়ন, তাঁদের নিরাপত্তা, অসহায় হাজিদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতেন।
খোলাফায়ে রাশেদার সেবা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর খোলাফায়ে রাশেদারাই হজের নেতৃত্ব দিতেন। তাঁরা হজের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং তাঁদের অসুবিধাগুলো দূর করতেন। বিশেষত তাঁদের খাবার ও পানীয় সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ছিল।
আব্বাসীয়দের সেবা : আব্বাসীয় শাসকরাও নিজেরা হজে অংশগ্রহণ করতেন। হাজিদের জন্য তাঁরা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে খলিফা মাহদি এবং তাঁর ছেলে হারুনুর রশিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খলিফা মাহদি সর্বপ্রথম হেরেমের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেন এবং খলিফা হারুনুর রশিদ হজ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। হারুনুর রশিদের স্ত্রী জোবায়দা হাজিদের পানিসংকট দূর করতে কৃত্রিম খাল খনন করেন, যা ইতিহাসে নাহরে জোবায়দা নামে পরিচিত।

মামলুকদের সেবা : মামলুক শাসকদের ভেতর সুলতান কালাউন ও সুলতান রোকনুদ্দিন বাইবার্সের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুলতান কালাউন মক্কার প্রশাসক নিয়োগের সময় শপথ নিতেন যেন সে, হাজিদের নিরাপত্তা ও সেবাদানে পূর্ণ মনোযোগ রক্ষা করে। সুলতান রোকনুদ্দিন মক্কা-মদিনা অঞ্চলের জন্য দ্বিগুণ রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ দিতেন, যেন প্রশাসন হাজিদের পরিপূর্ণ সেবা-যত্ন করতে পারে। (আরব ডটসিও ডটইউকে)
মোগলদের সেবা : মোগল সম্রাটরা হজযাত্রীদের বহনকারী জাহাজগুলো পণ্য-রসদে সাজিয়ে দিতেন। হজের সময় তাঁরা ভারত মহাসাগরে গমনকারী হাজিদের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীর টহল জাহাজ নিযুক্ত করতেন।
উসমানীয়দের সেবা : হাজিদের বিদায় জানাতে উসমানীয় সুলতানরা নিজেই উপস্থিত হতেন। তিনি হাজিদের সম্মানজনক উপহার দিতেন। তুর্কি হজ কাফেলায় সুলতানের পক্ষ থেকে একজন ‘আমিরুল হজ’ (হজ কাফেলার নেতা) নিযুক্ত করা হতো, যিনি হাজিদের সেবা ও সহযোগিতা করতেন এবং হাজিদের নিরাপত্তায় নিযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ১৯০০ সালে হজযাত্রা সহজ করতে হেজাজ রেলওয়ে নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইস্তাম্বুল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত প্রকল্পের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় এক হাজার ৩২০ কিলোমিটার। (ইসলাম অনলাইন ডটনেট)