যদি কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাইকে জিজ্ঞেস করা হয়, নিজের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেটার আবার পূজা করেন কেন? জবাবে তিনি হয়তো বলবেন, পূজা মূর্তির নয়—ঈশ্বরের। অর্থাৎ পূজাটা ওই মূর্তির জন্য নয়, পূজাটা ঈশ্বরের জন্য। একই প্রশ্ন কোনো মুসলমানকে করা হলে জবাব কী? যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মানুষের তৈরি কাবা শরিফের দিকে ফিরে নামাজ পড়েন কেন, এটা কি কাবার উপাসনার নামান্তর নয়? সম্প্রতি কলকাতার একটি টিভি চ্যানেলে এ বিষয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একজন কর্মকর্তার একটি প্রশ্ন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সেখানে প্রশ্ন করা হয়েছে যে মুসলমানরা কি কাবার পূজা করে? এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব হলো, না, মুসলমানরা কাবার উপাসনা করে না। মূর্তি সামনে রেখে পূজা করলে সেটা অবশ্যই মূর্তিপূজা। কিন্তু কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়লে সেটা কাবার উপাসনা নয়, বরং কাবার রবের ইবাদত। এর প্রথম কারণ হলো, মূর্তিপূজায় মূর্তি মুখ্য বিষয়। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে কাবা মুখ্য নয়, বরং এটি দিক নির্ধারণ ও একাগ্রতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে যদি কাবাঘর ভেঙে ফেলা হয় এবং ঘরটিকে আবার নির্মাণ করতে অন্তত কয়েক দিন সময় লাগে, তবু এ সময়ে নামাজ বন্ধ হবে না। ওই দিনগুলোতে বিশ্বের মুসলমানরা কাবাঘরের ফাঁকা স্থানের দিকে ফিরে নামাজ পড়বে।
দ্বিতীয়ত, কাবার দিকে নামাজ পড়ে কাবাকে সম্মান জানানো হয় না। সম্মান জানানো হয় আল্লাহকে। কেননা কাবাঘরের ভেতরে বসেও নামাজ পড়া যায়। কাবাঘরের ছাদের ওপরে উঠেও নামাজ পড়া যায়। এর বিপরীতে মূর্তির ভেতরে বা মূর্তির ওপরে বসে কি পূজা করা যায়?
তৃতীয়ত, কাবা উপলক্ষ মাত্র। মুসলমানদের নামাজ পড়তে কাবাঘর লাগে না। লাগে ওই স্থান, লাগে ওই দিক। কাবাঘর যেখানেই থাকুক অথবা না-ই বা থাকুক, নামাজ পড়তে হবে ওই দিকে ফিরে। ওখানে কাবঘর না থাকলেও নামাজ চলবে। ওই দিকে ফিরে নামাজ পড়তে হবে—এটা আল্লাহর আদেশ। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহর এই আদেশ দেওয়ার আগে আরেক দিকে ফিরে নামাজ পড়ার নিয়ম ছিল। কাবঘর নয়, মুসলমানদের প্রকৃত কিবলা হলো আল্লাহর নির্দেশিত দিক বা অভিমুখ।
চতুর্থত, কাবার দিকে ফিরে নামাজ আদায়ের কারণ হলো, আদিকাল থেকেই মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতি চলে আসছে যে যখন কোনো রাজা-বাদশাহর প্রশংসা ও গুণাবলি বর্ণনা করা হয়, তখন সর্বপ্রথম তাঁর সামনে দণ্ডায়মান হতে হয়, তারপর গুণকীর্তন ও প্রশংসা বর্ণনা শুরু করা হয়। নামাজের মধ্যে এই বিষয়টিকেই ইবাদত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর ইবাদতের প্রাণ হলো স্থিতিশীলতা ও একদিকে নিবিষ্ট হওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত ইবাদতকারী নিজ ইবাদতে একটি নির্দিষ্ট দিকে নিজেকে বাধ্য না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই নিবিষ্টতা ও স্থিতিশীলতা অর্জিত হবে না। এ জন্য নামাজের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ দিক নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সেটাই হলো কিবলার দিক।
পঞ্চমত, বাহ্যিকের সঙ্গে অভ্যন্তরের এমন নিবিড় সম্পর্ক আছে যে বাহ্যিককে কোনো এক দিকে অবলম্বন করা হলে অভ্যন্তরকে সেদিক অবলম্বন করার শক্তি প্রদান করে। এ জন্য নামাজে কাবার দিকে মুখ ফেরানো আবশ্যক।
ষষ্ঠত, সৃষ্ট জীবের মধ্যে সবার জন্য একটি নির্দিষ্ট কিবলা হওয়া আবশ্যক, যেন তাদের বাহ্যিক ঐক্য দ্বারা অভ্যন্তরীণ ঐক্য শক্তিশালী হয়। আর যখন ইবাদতের নুর ও বরকত অর্জনে বাহ্যিক ও অভ্যন্তর উভয় সমন্বয় হয়ে যাবে, তখন অন্তর জ্যোতির্ময় হওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি হবে। যেমন—এক স্থানে যদি অনেক বাতি প্রজ্বালন করা হয়, তখন সে স্থান অনেক আলোকিত হয়। এ জন্যই জুমা ও জামাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাতে এক মহল্লার লোকজন সমবেত হয় আর জুমার জামাতে এক শহরের লোকজন সমবেত হয়; আবার হজের সময় বিশ্বের সব মুসলমান সমবেত হয়। সমবেত হওয়া ইবাদতের নুরকে বৃদ্ধি করার কারণ হয়। যেহেতু বিশ্বের সব মুসলমান একই স্থানে সব সময় একত্র হওয়া অসম্ভব, এ জন্য সে স্থানের দিকটাকে ওই স্থানের পর্যায়ে গণ্য করে নামাজে সেদিকে ফেরার বিধান দেওয়া হয়েছে।
সপ্তমত, একদল মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়। তারা জড় ও জীবের পূজা করে। এটা তাদের উপাসনার একটা ধরন। মহান আল্লাহ তাঁর ইবাদতের পদ্ধতিকে বিশুদ্ধ করতে চেয়েছেন, যাতে ইবাদত শিরকমুক্ত হয়। এদিকে প্রত্যেক মুসলমানের বিশ্বাস ছিল যে মক্কায় বাইতুল্লাহকে একত্ববাদের মহান এক প্রচারক ইবরাহিম (আ.) নির্মাণ করেছেন এবং শেষ জামানায় তাঁরই বংশধরের এক মহান ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.) পূর্ণ শরিয়ত নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবেন। এবং তিনি তাওহিদ তথা একত্ববাদের আদর্শকে পুনর্জীবিত ও পূর্ণ করবেন। তাই মহান আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষাকে পূর্ণ করার লক্ষ্যে কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়তে হয়।
অষ্টমত, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো জায়গায় যায়, তখন সে জায়গায় যাওয়ার জন্য যে আদব-শিষ্টাচার রয়েছে, তার অনুসরণ করা হয়। পাশাপাশি এই শিষ্টাচার ওই ব্যক্তির প্রাপ্য হিসেবে ধরা হয়। যেমন—কোনো সিংহাসনে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে যদি ঝুঁকে সালাম করে, তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সিংহাসনে উপবিষ্ট সত্তা, সিংহাসন নিজে নয়। সুতরাং ‘বাইতুল্লাহ’ শব্দ দ্বারাও এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে ঘর উদ্দেশ্য নয়, বরং ঘরের মালিক উদ্দেশ্য। অর্থাৎ কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়া হলেও মূলত নামাজ কাবার মালিকের জন্য। এসব কারণে মুসলমানরা কাবার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করে।
[আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) রচিত ‘আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে’ থেকে সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর]
প্রশ্ন হলো, কাবাকে বায়তুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘর বলা হয় কেন, আল্লাহর জন্য ঘর থাকতে হবে কেন? এ প্রশ্নের জবাব হলো, কাবাকে বাইতুল্লাহ বলার কারণ এটা নয় যে আল্লাহ এই ঘরে অবস্থান করেন। কেননা সৃষ্টিজগতের কোনো কিছু আল্লাহকে আয়ত্তে আনতে পারে না। বরং এই ঘর আল্লাহকে সম্মান জানানোর স্থান (মহল্লে তাজিম)। তাই সম্মানসূচক অর্থে কাবাকে বাইতুল্লাহ তথা আল্লাহর ঘর বলা হয়।