সুপ্রাচীনকাল থেকে বৃহত্তর রাজশাহীর মাহীসন্তোষ এলাকা একটি বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধ জনপদ ছিল বলে ধারণা করা হয়। মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মাহীসন্তোষ অঞ্চলটি অধিকতর সমৃদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে থাকে। সমৃদ্ধির ধারা মোগল আমলের শেষ পর্যায় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সামরিক, প্রশাসনিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্কৃষ্ট কেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে মাহীসন্তোষ সমধিক খ্যাতি লাভ করে। সুলতান রোকনুদ্দিন বারবাক শাহ এই সমৃদ্ধিকে অনন্য উচ্চতা দান করেন। তিনি মাহীসন্তোষে একটি টাকশালও প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে অঞ্চলটি বারবাকাবাদ নামেও পরিচিতি লাভ করে। মুসলিম আমলে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক ভবন, সাধারণ ভবন, মাদরাসা, মসজিদ ও খানকার বেশির ভাগ কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও মাহীসন্তোষের বারোদুয়ারি মসজিদটি এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে।
মাহীসন্তোষ মসজিদ নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ১৯১৬ সালে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এই মসজিদটির ধ্বংসাবশেষযুক্ত ঢিবিটিতে উত্খনন করে। তখন মসজিদটির সামান্য অংশ উন্মোচিত হয়েছিল। পরে স্থানীয় মুসলিমরা জঙ্গল ও মসজিদের ঢিবির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলে এবং পুরানো মসজিদটির ওপর নামাজ পড়ার জন্য নতুন একটি চৌচালা টিনের ছাদে আবৃত মসজিদ নির্মাণ করেছে।
বর্তমানে টিকে থাকা বৈশিষ্ট্য থেকে এই মসজিদের আদি পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব। ধারণা করা হয়, ২.২৫ মিটার পুরু দেয়ালবিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদটির চার কোণে চারটি অর্ধ অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ ছিল। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ ইট দিয়ে নির্মিত এবং বাইরের দেয়ালের সম্মুখভাগ পাথরের ফলক দ্বারা আবৃত। মসজিদে প্রবেশের জন্য সম্মুখভাগে পাঁচটি প্রবেশপথ ছিল। উত্তর ও দক্ষিণের প্রতি পাশে তিনটি করে প্রবেশপথ ছিল। মসজিদের কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ পাশের অংশ অপেক্ষা বড় এবং তিনটি আয়তাকার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এগুলোর ছাদ সম্ভবত বাংলা চৌচালা রীতির খিলান ছাদে আচ্ছাদিত ছিল। আর এর দুই পাশের অংশ দুটি সম্ভবত আচ্ছাদিত ছিল সর্বমোট ১২টি অর্ধগোলাকার গম্বুজে।
সম্মুখভাগের প্রবেশপথের সমান্তরালে পশ্চিম দিকের দেয়ালে আছে পাঁচটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত সামান্য বড়। মিহরাবটি বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মূলত এই মিহরাবটি একটি পাথরখণ্ড দিয়ে নির্মিত এবং সুন্দর অলংকরণে সজ্জিত। শিকল ও ঘণ্টা, পদ্ম ও তালপত্র নকশা (Palmette) প্রধান মোটিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মিহরাবের কুলুঙ্গির কেন্দ্রীয় অংশ শিকল ও ঘণ্টা নকশায় অলংকৃত। শিকল নকশার পাশে একটি ঝুলন্ত পুঁতির মালার নকশা ছিল। শিকল নকশার নিম্নাংশে ছিল ঝুলন্ত প্রস্ফুটিত পদ্মের নকশা। মসজিদের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরখণ্ডের গায়ে অলংকরণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে যে মসজিদের বাইরের দেয়ালে পাথরে খোদাই করা অলংকরণ ছিল।
এই প্রত্নস্থল উত্খনন করতে গিয়ে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি একটি শিলালিপি আবিষ্কার করে। এই শিলালিপি থেকে জানা যায়, ৯১২ হিজরি/১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। পরে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি শিলালিপি পাওয়া যায়। শিলালিপিটি দুই সারিতে কালো কষ্টিপাথরে খোদাই করা। এটি সুলতান রোকনুদ্দিন বারবাক শাহর আমলে জনৈক উলুগ খান হাসান কর্তৃক ৮৬৭ হিজরি/১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে একটি মসজিদ নির্মাণের স্মারক। সম্ভবত যে মসজিদটি সুলতান রোকনুদ্দিন বারবাক শাহর আমলে ৮৬৭ হিজরিতে (১৪৬৩ খ্রি.) নির্মিত এবং সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলে এটি ৯১২ হিজরিতে (১৫০৬ খ্রি.) পুনর্নির্মিত হয়েছিল।
তথ্যঋণ : বাংলাপিডিয়া, প্রবন্ধ : মাহীসন্তোষে প্রাপ্ত মুসলিম পুরাকীর্তি : একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা, আইবিএস জার্নাল, ১০ সংখ্যা ১৪০৯