দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই বা মালাভি। রাষ্ট্রীয় নাম রিপাবলিক অব মালাউই। এটি নায়াসাল্যান্ড নামেও পরিচিত। মালাউইয়ের পশ্চিমে জাম্বিয়া, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে তানজানিয়া, পূর্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মোজাম্বিক অবস্থিত। লিলংগো দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। চিওয়া উপজাতির পূর্ব নাম মারাভি অনুসারে দেশটির নাম মালাউই হয়েছে। মালাউইকে আফ্রিকার উত্তপ্ত হৃদয় বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।
দেশটির মোট আয়তন এক লাখ ১৮ হাজার ৪৮৪ বর্গকিলোমিটার আর মোট জনসংখ্যা এক কোটি ৮১ লাখ ৪৩ হাজার ২১৭। রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী মুসলমানের সংখ্যা ১৩.৮ শতাংশ। তবে মুসলিমদের দাবি তাদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। স্থলবেষ্টিত মালাউই প্রাকৃতিক সম্পদ ও জ্বালানি তেলে সমৃদ্ধ। চুনাপাথর, কয়লা, অপরিশোধিত ইউরেনিয়াম, বক্সাইড, কৃষিভূমি ও জলবিদ্যুত্ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মালাউই আফ্রিকার একটি নতুন ভূমি। খ্রিস্টীয় দশম শতকে ‘বানতু’ উপজাতির লোকজন সেখানে প্রথম বসতি গড়ে তোলে। ষোলো শতকে মালাউইয়ের রাজনৈতিক উত্থান হয় এবং মারাভি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। তবে আঠারো শতকে সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং একাধিক গোত্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মালাউই।
মালাভিতে ইসলামের আগমন
আরব ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে মালাভিতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়। পনেরো শতকের শুরুতে আরব বণিকরা এই অঞ্চলে আসে এবং তাদের হাতির দাঁত, সোনা ও দাস ব্যবসা ছিল। মূলত মুসলিম শাসিত ‘কিলওয়া’ দ্বীপের ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মালাভির মানুষ প্রথম ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে। শায়খ আবদুল্লাহ মাকওয়ান্দা ও সাবিতি নাগাঞ্জে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ইউনেসকোর মতে, আরব বণিকদের মাধ্যমেই মালাভির প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। মালাভির বেশির ভাগ মুসলিম ‘ইয়াউ’ সম্প্রদায়ের। তাদেরকেই দেশটিতে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ উৎস মনে করা হয়। ইসলাম গ্রহণের আগে ইয়াউ উপজাতির গোত্রীয় প্রধানরা আরব বণিকদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। আরব মুসলিমদের সঙ্গে সুগভীর ব্যাবসায়িক সম্পর্কের কারণে ইয়াউ গোত্রের বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। ইয়াউ উপজাতি ছাড়াও চিওয়া, ইন্ডিয়ানসহ অন্যান্য উপজাতি ও গোত্রের মধ্যে ইসলামের প্রচার রয়েছে।
মালাভিয়ান মুসলিমদের সংগ্রাম
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই মালাভিয়ান মুসলিমরা প্রতিকূল রাষ্ট্রীয় আচরণের শিকার। ঔপনিবেশিক শাসকরা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করত। মূলত ঔপনিবেশিক শাসনের সহযোগী খ্রিস্টান মিশনারিগুলোই মুসলিমদের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে খেপিয়ে তোলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও যার প্রভাব রয়ে গেছে। ফলে দীর্ঘকাল মালাভিয়ান মুসলিমরা নিজ দেশে ধর্মীয় অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম করে গেছে। রাষ্ট্রীয় বৈরিতার কারণে মালাভিতে মুসলিম জনসংখ্যার হার ক্রমহ্রাসমান। ধারণা করা হয়, ঔপনিবেশিক আমলের আগে মালাভির বর্তমান ভূখণ্ডে মুসলিমের হার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ছিল, যা ঔপনিবেশিক শাসন ও খ্রিস্টান মিশনারির তৎপরতায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে গত শতকের সত্তরের দশকে মালাভিতে ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়। ঔপনিবেশিক আমলের তুলনায় মুসলিমরা ধর্ম পালনে স্বাধীনতা লাভ করে।
কেমন আছে মালাভির মুসলিমরা
বর্তমানে মালাভিতে আরব দেশগুলোর সহায়তায় বেশ কয়েকটি মুসলিম মিশনারি কাজ করছে। তাদের মধ্যে কুয়েতভিত্তিক আফ্রিকান মুসলিম এজেন্সি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। কুয়েতের অর্থায়নে সংস্থাটি স্থানীয় চিচিওয়া ভাষায় কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেছে। মালাভিতে ইসলামী শিক্ষার প্রসারেও আফ্রিকান মুসলিম এজেন্সির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মালাভিতে প্রায় ৮০০ জুমার মসজিদ আছে। প্রায় সব শহরে একাধিক মসজিদের দেখা মেলে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ‘রেডিও ইসলাম’ নামে একটি নিজস্ব রেডিও স্টেশন রয়েছে মুসলিমদের। ধীরে ধীরে মালাভিয়ান মুসলিমরা দেশীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছে। দেশটির স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন মালাভিয়ান মুসলিম বাকিলি মুলুজি। তিনি ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
লেখক : সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা