বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারমেন। বাংলাদেশ সময় গত বৃহস্পতিবার রাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে ওয়েন্ডি শারমেন বৈঠক করেন। বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এ তথ্য জানান।
উল্লেখ্য, ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়েন্ডি শারমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি।
মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করতে ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট ওয়েন্ডি শারমেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁরা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করেছেন। ডেপুটি সেক্রেটারি শারমেন মানবাধিকার, আইনের শাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। ’
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই বৈঠককে ফলপ্রসূ বলে মন্তব্য করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুকবার্তায় বলা হয়েছে, ‘বৈঠকে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ’
ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পররাষ্ট্রসচিব র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় উদ্বেগ জানান। তিনি বলেন, এটি সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে পারে। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, সরকার র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর প্রতিকার করছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী হিসেবে নিষেধাজ্ঞা থেকে র্যাবকে সাময়িকভাবে ছাড় দিতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি সুরক্ষা এবং নারী ও শিশুদের রক্ষায় সরকার এই আইন প্রণয়ন করেছে। আইনটির পর্যালোচনা ও ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে কাজ করছে।
শ্রম ইস্যুতে পররাষ্ট্রসচিব ইইউ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে মিলে রোডম্যাপ প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্রকেও এ উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, রাতারাতি সব কিছু বাস্তবায়ন করা যায় না। ধীরে ধীরে উন্নতি অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, ওয়েন্ডি শারমেন বাংলাদেশে শ্রম অধিকার, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারসংক্রান্ত সংস্কার প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং পরবর্তী গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সম্ভাবনার বিষয়েও আলোচনা করেন।
পররাষ্ট্রসচিব মোমেন বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন প্রণয়নের মতো অগ্রগতি এবং দেশব্যাপী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে শারমেনকে অবহিত করেন।
বৈঠকে উভয় পক্ষ ইউক্রেনের পরিস্থিতি এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং সামুদ্রিক এলাকায় শৃঙ্খলাভিত্তিক ব্যবস্থার বিষয়ে আলোচনা করেছে। উভয় পক্ষই নিরাপত্তা খাতে সহযোগিতার বিষয়ে আরো কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব মোমেন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফরের সম্ভাবনা এবং জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের বিষয়েও আলোচনা করেন।
পররাষ্ট্রসচিব যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনসংখ্যা, শরণার্থী ও অভিবাসনবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জুলিয়েটা নয়েস, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ পরিচালক সুমনা গুহের সঙ্গে বৈঠক করেন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জুলিয়েটা নয়েস শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আশা সৃষ্টি না হলে তারা উগ্রবাদ ও আন্তর্দেশীয় অপরাধের জন্য বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করবে—পররাষ্ট্রসচিবের এ বক্তব্যের সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করেন। সুমনা গুহের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকেও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে আলোচনা করেন।
আগে প্রতিরক্ষা চুক্তি পরে অস্ত্র কেনাকাটা : এদিকে গত বুধবার ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অষ্টম নিরাপত্তা সংলাপের পর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে হলে আগে ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট (জিসোমিয়া)’ স্বাক্ষর করতে হবে। এ ছাড়া ‘অ্যাকিউজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস অ্যাগ্রিমেন্ট (আকসা)’ স্বাক্ষর করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে। জিসোমিয়া চুক্তিতে নিরাপত্তা সম্পর্কিত স্পর্শকাতর তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে আকসা চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে খাদ্য, জ্বালানি, পরিবহনসহ অন্যান্য রসদ বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ফোর্সেস গোল বাস্তবায়ন ও সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনতে চায়। গত মাসে ঢাকায় অংশীদারি সংলাপের সময় যুক্তরাষ্ট্র জিসোমিয়া চুক্তির খসড়া হস্তান্তর করে। বাংলাদেশ এ নিয়ে কাজ করছে। আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় নবম নিরাপত্তা সংলাপের আগে জিসোমিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
এদিকে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র বড় পরিসরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এখন রুশ অস্ত্র বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভারসারিস থ্রো স্যাংকশান্স অ্যাক্ট (ক্যাটসা)’ নামে যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইন আছে। এই আইনে যুক্তরাষ্ট্র তার নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা দেশের কাছ থেকে সামরিক বা প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনলে ক্রেতা দেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।