Sunday, October 1, 2023
spot_img
Homeধর্মমসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের রূপরেখা

মসজিদভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের রূপরেখা

৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় বাংলাদেশে, আদমশুমারি তথ্যানুযায়ী প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলিমের বসবাস। এই নব্বই শতাংশ মুসলিম, ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগি করার লক্ষ্যে নিজস্ব উদ্যোগে, নিজস্ব অর্থায়নে কয়েক লাখ মসজিদ গড়ে তুলেছে। আধুনিক স্থাপত্যরীতি ও চোখধাঁধানো নান্দনিকতা খুব একটা না থাকলেও, রাজধানী ঢাকাতেই বিশালসংখ্যক মসজিদ আছে। সে হিসেবে বিশ্বের বুকে ঢাকার পরিচিতি মসজিদের শহর বলে। গাজীপুর সিটির মধ্যেই বাইশ শ মসজিদ রয়েছে। সারা সপ্তাহে মুসল্লিদের খুব একটা মসজিদে দেখা না গেলেও, শুক্রবারের জুমায় কানায় কানায় ভরপুর হয়ে ওঠে। তাকবির-তাসবিহে মনকাড়া দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। 

এতসংখ্যক মসজিদ আর মুসলিমের দেশ হলেও মসজিদের বাইরে ইসলামের অনুশীলন অনেকাংশেই অনুপস্থিত। নামাজের সময় যে অর্থে ইমামকে নেতা বানিয়ে তার ইক্তেদা (অনুসরণ) করা হয়। ঠিক একই অর্থে সমাজব্যবস্থায় ইমামের নেই কোনো নেতৃত্ব। চোখে পড়ার মতো নেই কোনো কার্যক্রম। ফলে বেশির ভাগ মুসলিমই মনে করে, মসজিদ শুধু নামাজ-কালাম পড়ার স্থান। সামাজিক কাজে মসজিদের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। ইমামের নেই কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা। সমাজব্যবস্থায় যেহেতু মসজিদের কোনো কাজ নেই, তাই ইমামেরও নেই কোনো সামাজিক দায়িত্ব। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে ইমামের নেতৃত্ব শুধু মসজিদের নামাজে। আর সামাজিক কাজের নেতৃত্ব এলাকার মোড়লদের হাতে। ইমাম যেমন সমাজের ধার ধারে না, তেমনই সামাজিক মোড়লরাও ধর্মের ধার ধারে না। ফলে মসজিদে ইসলামের অনুশীলন থাকলেও, সমাজে ইসলামের অনুশীলন নেই।  
অথচ আপনি খোলাফায়ে রাশেদিন ও ইসলামের সোনালি যুগের দিকে লক্ষ করুন। সে সময়গুলোতে মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিমসমাজের সব কার্যক্রম সমাধা হতো। সামাজিক বিচার-আচার, বিবাহ-শাদি ইত্যাদি কার্যক্রম মসজিদকে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হতো। রাষ্ট্রীয় ফরমান, সতর্কবার্তা, এমনকি যুদ্ধের মতো ঘোষণাও মসজিদের মিম্বর থেকে ঘোষিত হতো। কিন্তু যখন থেকে মসজিদ থেকে সামাজিক কার্যক্রম পৃথক হতে লাগল, তখন থেকেই নেতৃত্বেও বিভাজন হতে লাগল। ইসলাম আটকে থাকল মসজিদে আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে।  সমাজ ও রাষ্ট্র হতে লাগল ইসলামী অনুশাসনহীন।  

শুধু নামাজ পড়ানোই ইমাম সাহেবের কাজ না। পুরো সমাজ তার অধীনে, পুরো মহল্লায় তার নেতৃত্ব চলবে। শরিয়তের বিধান তারা মানুষকে জানাবেন, সত্কাজের আদেশ করবেন এবং অসত্কাজের নিষেধ করবেন। তাদের কথামতো সাধারণ মুসল্লিরা কাজ করবেন। মসজিদের সভাপতি হোক বা সেক্রেটারি, সবাই ইমাম সাহেবের অধীনে। মসজিদে মুসল্লি বাড়ানো ইমাম সাহেবের দায়িত্ব, পুরো মহল্লার মধ্যে দ্বিনি চেতনা ছড়িয়ে দেয়া ইমাম সাহেবের কাজ। শুধু নামাজ পড়ানো তার দায়িত্ব না। 

মসজিদকে কেন্দ্র করে, সামাজিক কাজ ও ইমামের সামাজিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কিছু কৌশল ও কর্মসূচি এমন হতে পারে :  

এক. 

মসজিদকে কেন্দ্র করে সামাজিক কাজের জন্য ইমাম সাহেবের নেতৃত্বে,  মহল্লাভিত্তিক ইসলামী সমাজকল্যাণ সংঘ গড়ে তোলা। এলাকার সকল মুসল্লি এর অঘোষিত সদস্য হবে। নিয়মিত নামাজিরাই এর কার্যক্রম পরিচালনা করবে। অপেক্ষাকৃত তরুণদের কাজে যুক্ত করে, মুরুব্বিরা উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করবে। ইমাম, খতিব ও শিক্ষিত দ্বিনদার তরুণদের নেতৃত্ব দিতে হবে। চিন্তাশীল, সমঝদার, উদার মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত। 
মুসল্লিদের স্ব-ইচ্ছা দান ও এককালীন অনুদানই এর একমাত্র আয়ের উত্স। আমানতদার ক্যাশিয়ারের মাধ্যমে, যথাযথ কাগজপত্রে লিখিত আকারে বার্ষিক অডিটে এর সর্বোচ্চ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা করতে হবে। এলাকার যেসব বিত্তবান মানুষ শহরে থাকেন, যারা শহরে-বন্দরে ভালো চাকরি করেন কিংবা বিদেশে থাকেন, বিশেষত তাদের কাছ থেকে কালেকশন করার চেষ্টা করতে হবে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।   

দুই. 

ঈদ, দুর্যোগকালীন সময় ও শীতকালীন সময়ে মহল্লার ধনবান মুসল্লিদের উত্সাহিত করে, দরিদ্র মুসল্লিদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে। কাপড়চোপড়, কম্বল ইত্যাদি বিতরণ করা হবে। 

তিন. 

কোরবানির সময় মহল্লায় যারা কোরবানি দেয় তাদের থেকে গোশত সংগ্রহ করে, যারা দিতে পারেনি, তাদের লিস্ট করে, ইমামের নেতৃত্বে তাদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে হবে। 

চার. 

মাঝে মাঝে কাজে লাগে, তবে নিয়মিত লাগে না, এমন কিছু জিনিস যেমন : কুড়াল, খুন্তি বা শাবল, কোদাল, ছুড়ি চাকু, দাঁড়িপাল্লা ইত্যাদি যন্ত্রপাতি সামাজিকভাবে ক্রয় করে রাখা হবে। যার যখন প্রয়োজন হবে ইমামের কাছে নাম ও ফেরত দেওয়ার সময় লিখে নিয়ে যাবে। কাজ শেষে যথাযথভাবে পৌঁছে দেবে।  

পাঁচ. 

কর্জে হাসানার প্রতি উত্সাহিত করে কর্জে হাসানা ফান্ড গঠন করতে হবে। আপত্কালীন সময়ের জন্য সাক্ষীসহ লিখিত আকারে উক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থই সকল অনর্থের মূল। অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে কর্জে হাসানার দরকার নেই। সুন্দর ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা জরুরি। নইলে ফিতনা দেখা দেবে। 

ছয়. 

মক্তব চালু করতে হবে। যেখানে মকতব চালু আছে সেখানে আরো জোরদার করতে হবে। মকতব চালু থাকলেও বাচ্চাদের কুরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ হয় না অনেক জায়গায়। এর কয়েকটি কারণ হতে পারে : 

১. শিক্ষক পর্যাপ্ত থাকে না। একজন শিক্ষক ৫০/৬০ বা আরো বেশি বাচ্চা পড়াতে হয়। 

২. শিক্ষকের কোরআন তিলাওয়াত শুদ্ধ না। শুদ্ধ হলেও নুরানি ট্রেনিং না থাকার কারণে ফায়দা হয় না। 

৩. শিক্ষকের বেতন অনেক কম। যে কারণে সময় দেয় না। অথবা আরো শিক্ষক দরকার হলে টাকার অভাবে শিক্ষক রাখতে পারে না। 

৪. কর্তৃপক্ষ কোরআন তিলাওয়াত বিশুদ্ধ হওয়া; তথা দ্বিনি বিষয়ে ও পড়ালেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, যে কারণে শিক্ষক ফাঁকিবাজি করার সুযোগ পায় ইত্যাদি কারণ। 

এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় মসজিদ কমিটিতে এক বা একাধিক আলেমকে স্থান দেওয়া। তিনি বুঝবেন তিলাওয়াত শুদ্ধ হচ্ছে কিনা। উলামায়ে কেরামের উচিত নিজের মহল্লার প্রতি সুনজর রাখা। অনেক আলেম নিজ মহল্লার খোঁজ নেন না। মাঝেমধ্যে বাড়িতে গেলেও মহল্লার মসজিদ ও মকতবের সার্বিক পরিস্থিতির খবর নেন না। এটা অনুচিত। সব আলেম যদি নিজ নিজ পাড়া-মহল্লা ও এলাকার খোঁজ নেন, তাহলে দ্বিনি পরিবেশ আরো প্রাণবন্ত হবে, ইনশাআল্লাহ। 

সাত. 

বিয়ে-শাদি মসজিদে করার জন্য উত্সাহিত করা। অবশ্য অলিমার আয়োজন মসজিদের বাইরে হওয়া চাই। না হয় মসজিদের আদব রক্ষা করা সম্ভব হবে না।  
আট. 

সামাজিক বিচার-আচার মসজিদ-প্রাঙ্গণে করার ব্যবস্থা করা। ঝগড়া ও দ্বন্দ্ব নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করা। মসজিদের ইমাম প্রভাবশালী হলে তিনিই বিচার করতে পারেন। অন্যথায় মসজিদ কমিটির প্রভাবশালী আমানতদার লোক বিচার-আচার করবেন। ন্যায়নিষ্ঠভাবে আমানতের সঙ্গে বিচার করতে পারলে কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ার নিচে স্থান পাবে। 

নয়. 

মানুষকে মসজিদমুখী করার জন্য উত্সাহিত করা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে ইসলামের দিকে টার্গেট করে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে নামাজ পড়লে শিশুদের উত্সাহ দিতে পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে।  

দশ. 

মসজিদভিত্তিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে ইসলামি জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করা। মসজিদে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার খুবই জরুরি। ইসলামের মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি ইতিহাস, সিরাত ইত্যাদি বইপুস্তক থাকবে। এলাকার শিক্ষিত লোকজন যেন উক্ত পাঠাগার থেকে বইপত্র নিয়ে পড়েন—এজন্য তাদের উত্সাহ দিতে হবে। মাঝেমধ্যে বা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন : রবিউল আওয়ালে ছোট্ট একটি সিরাতের বই থেকে প্রতিযোগিতা গ্রহণ করা এবং পুরস্কার বিতরণ করতে হবে। এর দ্বারা মানুষজনের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে। 

এগারো. 

একটি মসজিদের সব মুসল্লি একই মতাদর্শের না। বিভিন্ন ইসলামী মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এজন্য সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। অন্য ঘরানার অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতে হবে। যেমন ধরুন, মসজিদে সাপ্তাহিক গাশতের দিনে চরমোনাইয়ের ভাইয়েরাও অংশগ্রহণ করতে পারেন। তাদের হালকায়ে জিকিরের দিন অন্যরাও শরিক হতে পারেন। কোনোভাবেই যেন হকপন্থী দল ও মতাদর্শের মধ্যে কোনো বিভেদ না হয়, এই চেষ্টা করতে হবে। 

বারো. 

মসজিদে গাশত হলে নিয়মিত গাশত করতে হবে, না হলে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নামাজি হয়, দ্বিনমুখী হয়। তাই তাবলিগের সব কার্যক্রমের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। 

তেরো. 

মসজিদে তাবলিগের তালিম চালু থাকলে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাবলিগের তালিম চালু থাকুক বা না থাকুক, ইমামের উচিত হলো, দৈনন্দিন যে-কোনো নামাজের পর কোনো বই থেকে তালিম করা। রিয়াজুস সালেহিন বা অন্য কোনো কিতাব। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে যে ওয়াক্তে মুসল্লি বেশি হয় সে ওয়াক্তে তালিম করলে ভালো হয়। একাধিক ওয়াক্তেও তালিম করা যায়।  

দৈনন্দিন তালিমের পাশাপাশি মাসিক বা সাপ্তাহিক দরসে হাদিস বা তাফসিরুল কোরআন আলোচনা হতে পারে। নারীদের জন্য পর্দার সঙ্গে পৃথক ব্যবস্থা রাখতে পারলে ভালো। আমাদের দেশে সাধারণত বাত্সরিক ওয়াজ-মাহফিল করানো হয়। মসজিদের উদ্যোগেও করা হয়ে থাকে। প্রথাগত এসব মাহফিলের মাধ্যমে তেমন কোনো ফায়দা হয় না। তাই এসব মাহফিল বর্জন করা উচিত। হ্যাঁ, কোনো ভালো আলেমকে দাওয়াত করে এনে মাঝেমধ্যে তাঁর আলোচনা শোনা উচিত। এজন্য তো মাহফিলের প্রয়োজন নেই, মসজিদেই আলোচনা হতে পারে। 

চৌদ্দ. 

মসজিদের পাশে সুন্নাহ শপ নামে একটি দোকান থাকা উচিত। বিশেষত বাজার ও শহরের মসজিদগুলোতে। সুন্নাহ শপে আতর, টুপি, জায়নামাজ, কাফনের কাপড় ইত্যাদি থাকবে। মসজিদের মার্কেট থাকলে কম টাকায় ভাড়া দিয়ে হলেও এমন একটি শপ থাকা উচিত। এলাকার উদ্যমী ও উদ্যোগী লোকজন এগিয়ে এলে এমন শপ করা কঠিন ব্যাপার না। এই শপে দ্বিনি বইপুস্তকও থাকবে। দীনি বইপুস্তক কি জরুরি না? হাদিস ও তাফসিরের কিতাব থাকবে, এলাকা অনুপাতে বইয়ের স্তর ও মান নির্ণয় করা হবে। 

মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি সুশৃঙ্খল ও সুন্দর সমাজ গঠন করা সম্ভব। দরকার উদ্যোগের। উদ্যোগী কিছু মানুষ এগিয়ে এলে অন্যরাও পেছনে আসবে। কে কী বলল—এসব চিন্তা করা যাবে না। আসুন, আমরা যার যার স্থান থেকে চেষ্টা করি। 

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments