গ্রিক ও তুর্কি যুদ্ধজাহাজগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই একে অপরের শক্তিমত্তা পরখ করে দেখছে। এথেন্স ও আঙ্কারার রাজনৈতিক নেতারা আবার একে অপরের দৃঢ়তার পরীক্ষা নিচ্ছেন। বিরোধের মূল কারণ হলো পূর্ব ভূমধ্যসাগরে খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান নিয়ে। উভয় দেশই এই সম্পদের দাবিদার। তবে তীব্র বাগাড়ম্বর আর তর্জনগর্জন সত্ত্বেও, কোনো পক্ষই যুদ্ধ করতে অতটা আগ্রহী নয়। ঠিক তেমনি কেউই আবার পিছু হটতে বা নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করতে রাজি নয়। বার্তাসংস্থা এপির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে এমনটা বলা হয়েছে।
খবরে বলা হয়, ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও তুরস্ক নিজেদের বিমান ও নৌ যান ও সমরাস্ত্রের মেলা বসিয়েছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সামরিক মহড়ায় অংশ নিচ্ছে। ফলে কোনো ভুলের কারণে সংঘাত সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মাসের গ্রিসের একটি ফ্রিগেট দুর্ঘটনাবসত তুরস্কের একটি যুদ্ধজাহাজে ধাক্কা মারে। তখন যেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকেই বিপদের মাত্রা অনুমান করা যায়।
উপর থেকে দেখলে মনে হবে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের গভীরে খনিজ স¤পদের দখলকে কেন্দ্র করে এই সংঘাত। গ্রিস বলছে, ক্রিটের যেই উপকূল ঘেঁষা সমুদ্র অঞ্চলে তুরস্ক তেল ও গ্যাসের জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে, তা গ্রিসের এক্সক্লুসিভ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। অতএব, এই অনুসন্ধান কাজ গ্রিসের স্বার্বভৌম অধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘণ।
একই কথা বলছে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। দেশটি তুরস্কের বিরুদ্ধে ‘দস্যুর মতো আচরণ’ করার অভিযোগ এনেছে। সাইপ্রাসের উপকূলে যুদ্ধজাহাজের পাহারায় নৌ যান পাঠিয়েছে তুরস্ক। এমনকি ফ্রান্সের টোটাল সহ বিভিন্ন বৃহৎ জ্বালানী কো¤পানিকে অনুসন্ধানের অনুমতি দেওয়া অঞ্চলেও তুর্কি জাহাজ ভিড়েছে। একে কটাক্ষ করে ‘গানবোট কূটনীতি’ও বলছে সাইপ্রাস।
অপরদিকে তুরস্ক বলছে, জ্বালানী রিজার্ভে নিজের অধিকার সুরক্ষিত করতে যা করা আবশ্যকীয় তা-ই করছে তুরস্ক। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু জ্বালানী বা খনিজ অনুসন্ধানই তুর্কি কৌশলের একমাত্র লক্ষ্য নয়।
তুরস্ক এক বৈশ্বিক খেলোয়াড়ে পরিণত হতে চায়। হতে চায় ইসলামি বিশ্বের নেতা, যার ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে নিজের ইচ্ছা মতো রূপ দেওয়া যাবে। দেশটির এই কৌশলগত উচ্চাকাঙ্খার সঙ্গে এই শক্ত আচরণের সঙ্গতি রয়েছে।
মার্কিন থিংকট্যাংক দ্য জার্মান মার্শাল ফান্ড-এর রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়ান ও. লেসার বলেন, ‘এটি জ্বালানির বিষয় নয়। এই অঞ্চলে নিজের স্বার্থ নিয়ে তুরস্কের যেই চিন্তাভাবনা, তারই বৃহত্তর রুপায়ন দেখতে পাচ্ছি আমরা।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান নিজ দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও দুর্বল অর্থনীতি বেকায়দায় আছেন। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক লাইজেল হিন্টজ বলেন, গ্রিস, সাইপ্রাস, ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে যেই জ্বালানী-ভিত্তিক আংশিদারিত্ব হয়েছে, তাকে শত্রুভাবাপন্ন মনে করে আঙ্কারা। এই আংশিদারিত্বের মাধ্যমে তুরস্ককে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা হয়েছে। আঙ্কারা তাই এর বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে চায়।
সম্প্রতি লিবিয়ার সঙ্গে যে সামুদ্রিক সীমান্ত চুক্তি হয়েছে তুরস্কের, তার আংশিক কারণ হলো এটা দেখানো যে, কোনো আঞ্চলিক জ্বালানী পরিকল্পনা আঙ্কারার অন্তর্ভুক্তি ছাড়া এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
তবে তুরস্কের আগ্রাসী সামরিক মনোভাব এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে অনেকে মনে করছেন। আর এর ফলে নতুন কোনো বন্ধুও জুটছে না দেশটির। লেসার বলেন, ‘আপনি এবার তুরস্কের অবস্থানের পক্ষে আটলান্টিকের এ পাশে বা ওই পাশে তেমন সমর্থক খুঁজে পাবেন না।’
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য গ্রিস ও সাইপ্রাস বারবার তুরস্ককে এই জ্বালানী আংশিদারিত্বে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে আঙ্কারাকে এই আগ্রাসী কৌশল বাদ দিয়ে নিয়ম মানার শর্ত দিয়েছে দেশ দু’টি।
তবে লেসার বলছেন, এসব আংশিদারিত্বে যোগ দেওয়ার কোনো ইচ্ছেই তুরস্কের নেই। কারণ, দেশটি মনে করছে, এসবে যোগ দিলে তাদের গতিবিধি সীমিত হয়ে যাবে। পাশাপাশি, এই অঞ্চলে দেশটির বৃহত্তর সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। দুই দেশকে নিজ নিজ বাহিনীকে প্রত্যাহার করে আলোচনায় ফিরিয়ে নিতে জার্মানের নেতৃত্বে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হলেও, সেখান থেকে এখন পর্যন্ত চমকপ্রদ কোনো ফলাফল আসেনি।
২৭ সদস্যবিশিষ্ট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই ইস্যুতে শান্ত থাকার আহ্বান যেমন জানিয়েছে, তেমনি তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠোরতর অবরোধ আরোপের কথাও তুলেছে। তবে ইইউ’র কূটনীতি বা ওয়াশিংটনের বিনীত অনুরোধ আদৌ তুরস্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। ওয়াশিংটনের বিশ্বাসযোগ্যতা বিভিন্ন কারণে আঙ্কারায় ব্যাপক হোঁচট খেয়েছে।
লেসার বলেন, ‘তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ আংশিদার রাষ্ট্রসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের স¤পর্ক এই মুহূর্তে এত অকার্যকর পর্যায়ে রয়েছে যে, আঙ্কারার সঙ্গে এই ধরণের কূটনৈতিক আলাপে স¤পৃক্ত হওয়া ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’
তুরস্কে এই মুহূর্তে ৪০ লাখ সিরিয়ান বসবাস করছে। যেটি ইউরোপের প্রেক্ষিতে আঙ্কারার সবচেয়ে বড় কার্ড। কেননা, ইউরোপ চায় না, এই অভিবাসীরা ফের ইউরোপে পাড়ি জমাতে শুরু করুক।
এই অচলাবস্থার কি কোনো আইনি সমাধান আছে? সকল পক্ষই দাবি করে যে আন্তর্জাতিক আইন তাদের সামুদ্রিক সীমান্ত দাবির পক্ষে। তাই আদালতে বিষয়টির ফয়সালাই হয়তো যৌক্তিক হতে পারে। তবে তুরস্ক আইনি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। কেননা, দেশটির দাবির স্বপক্ষে জোরালো আইনি ভিত্তি নেই। লেসারের মতে, তুরস্কের অনেক দাবিই প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, ‘তারা যদি সরাসরি আইনি পথে যায়, তাহলে তারা হয়তো মনে করছে যে তাদের অবস্থান কিছুটা দুর্বল। এই বিষয়ে তারা হয়তো সঠিকই ভাবছে।’
তবে ভূমধ্যসাগরের এই জুয়ায় তুরস্ক হয়তো সীমা অতিক্রম করে ফেলতে পারে। লেসার বলেন, ইতিমধ্যে লিবিয়া ও সিরিয়ায় দেশটির সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। তবে এসব দেশে সাফল্য থেকেই আঙ্কারা হয়তো অন্যত্রও স¤পৃক্ত হতে উৎসাহ পেয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয় সাধ্যের মধ্যে, আর ফলাফলও অনুমেয়। গ্রিস আর সাইপ্রাস ইস্যুতে স্থানীয় জনগণের স¤পূর্ণ সমর্থনও এরদোগানের পক্ষে।