সত্যি সত্যিই কি ভারতীয় সংবিধান থেকে এবার ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটাকে ঝেড়ে ফেলা হবে? নাকি এদেশে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা একমাত্র সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দুদের জন্যই পাপ্য হতে চলেছে! কি চাইছেন দেশের মোদী সরকার? এমনই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আজকের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায় শোনার পর। ১৯৯২সালের ৬ ডিসেম্বর। এখনো মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। তখন ইন্টারনেট ছিল না। তাই সংবাদ জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল প্রিন্ট মিডিয়া ও হাতে গোনা দু একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া। যাদের আবার কোনটিই ২৪ ঘন্টা খবর সম্প্রচার করতো না। ফলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সব খবরই আমরা পাচ্ছিলাম খানিকটা অবিন্যস্তভাবে। কিছুটা টিভির সংবাদ আর কিছুটা লোকমুখে। ফলে চাপা সেই উত্তেজনার দিনে বাতাসে হু হু করে ছড়াচ্ছিল গুজব। আমি সেই দিন নিজের কর্মসুত্রে ছিলাম পার্ক সার্কাসের মুসলিম অধ্যুষিত একটি বস্তি অঞ্চলে। বিকাল তিনটে নাগাদ এলাকায় একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। দেখলাম ক্রমেই সেই গুঞ্জন বারতে বারতে প্রায় সশব্দে পরিণত হয়ে জনক্ষোভের চেহারা নিল। আমি এক মুসলিম বাড়িতে নিজের কাজে গিয়েছিলাম। ওই বাড়ির কয়েকজন মুসলিম যুবক আমায় সাবধান করে বলল, দাদা আভি অ্যাপ নিকালিয়ে ম্যাৎ, বাহার মে ধুম ম্যাচরা হ্যা হ্যায়? অ্যাপকা জান খাতরে মে পর সাক্তি হ্যায়”। আমি ওই ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম বড়সর কিছু একটা ঘটেছে। নাহলে এরা তো এভাবে কথা বলার মানুষ নয়। জিজ্ঞাসা করলাম “কেন? আমি বেরোবো না কেন? “ছেলেগুলো জানাল একটু আগেই নাকি অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই তার খবরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদাযড়ক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। এখন আমার বেরোনটা মোটেই নিরাপদ নয়। আমার আজো মনে পড়ে পার্ক সার্কাস অঞ্চলের সেই মুসলিম পরিবারের কথা যারা সেদিন আমায় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে হাজারো ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শিয়ালদ রাজাবাজার পার করিয়ে তবে আমায় ছেড়ে ছিল। ওদের একজন সাকিল ভাই, একজন রাহিস ভাই, আর একজন ছিল ইলিয়াস। সেদিন এই তিনজন আমায় সাহায্য না করলে আজ হয়তো আমি ছবি হয়ে দেওয়ালে টাঙানো থাকতাম। পরে পাড়ায় ফিরে ঘটনার বিস্তারিত জানতে পারলাম। মূল বিষয়টা কি হয়েছে এবং তার পরিণতিতে গোটা দেশে কিভাবে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সময় প্রায় সপ্তাহ খানেক এরাজ্েযর বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা চলেছিল। মেটিয়াব্রুজ, গর্ডেনরীচ থেকে কসবা তিলজলাসহ সর্বত্রই কিছু না কিছু দাঙ্গার খবর পাচ্ছিলাম। যারই সাথে ছড়াচ্ছিল গুজব আগুনের গতিতে। বেলেঘাটা নারকেল ডাঙ্গা, রাজাবাজার সর্বত্রই সেনাবাহিনীর টহল চলেছিল। ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোর কথা যা আজো মনে পড়লে রাতের ঘুম উবে যায়। সেই দিন বাংলায় রাজপথে একমাত্র মমতা ব্যানার্জী ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক নেতাকে দেখা যায়নি। আর সিপিএম! সেই সময় সিপিএম পার্টিটা হিন্দু মসুলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক পোড় খাওয়া সিপিএম নেতাকে সেদিন বলতে শুনেছিলাম “আমি আগে হিন্দু তারপর কমরেড”। সেই সময়ের সেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের যারা নেপথ্েয নায়ক ছিল এদিন অর্থাৎ আজ দেশের লাক্ষনৌ ন্যায়ালয় তাদের বেকসুর খালাস করে দিল। যেখানে বিজেপির উমা ভারতী এল কে আদবানী, মুরোলি মোনহর যোশীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অভিযোগ থেকে রেহাই পেলেন। যদিও এই রায় একদমই অনভিপ্রত নয়। বিশেষ করে সময়টা যখন গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের শাসনকাল। শুরু থেকেই বর্তমান সরকার দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে যে অতীতের আর সকল সরকারের থেকে ভিন্ন মত পেষোন করেন তা এরা শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছে। বেশ প্রথম দিকে তিন তালাক বিল নিয়ে। তখন মুসলিম সমাজের মধ্যযুগিয়ো একটি সংস্কারকে তুলে দেওয়াটাকে আমার মত সেকুলার মানুষও সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু যতই দিন গড়িয়েছে এদের উদ্দেশ্যটা এখন ক্রমেই পরিস্কার হয়ে গেছে বলা যায়। যেখানে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লোপ করা থেকে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের রায় এবং সর্বোপরি ৩০ সেপ্টেম্বরের রায়, যার সবটা দেখে শুনে বলতে অসুবিধা নেই দেশ এখন পুরোদস্তুর ধর্মান্ধকরণের পথে। যেখানে মর্যাদা পুরোষোত্তম রাম ছাড়া আর কোন মত পথের অবশিষ্টাংশ থাকবে না। ভয়ঙ্কর এই পথে জানিনা আমাদের আরো কত মৃত্যু আর লাশের পাহাড় গুনতে হবে। যেখানে বিচার ব্যবস্থার এই বেসরম রায় আদপে যে ভারতীয় ঐক্য সংহতির পিঠে ছুঁড়ি মারার সামিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।