রুমিন ফারহানা
একটা রাষ্ট্রে উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকলে সেটি পুরো রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে, সমাজকে এবং ব্যক্তিকে গণতান্ত্রিক করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই ঠিক উল্টোটা ঘটে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দল/গোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষকেও স্বৈরতান্ত্রিক করে তোলে। তাই এমন ব্যবস্থার অধীনে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানও তার নিজেকে একজন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দেখতে চান। আর সব স্বৈরাচারী মানুষ হয়ে থাকেন ইগোসেন্ট্রিক। নিজে যা বলেছেন, করেছেন, সেটা ভুল হয়েছে বুঝতে পারলেও তাদের পক্ষে সেটা স্বীকার করা সম্ভব হয় না, সংশোধন তো পরের কথা
সালটা ২০১২। যতদিন বেঁচে থাকবো ২০১২ সালের দিনগুলো আমার মনে থাকবে। সে বছরই বাবাকে হারাই আমি। বছরের প্রায় পুরোটা সময়ই বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল আমাকে। কয়েক দফায় বিভিন্ন মেয়াদে হাসপাতালে ছিলেন তিনি।
শেষ দফায় অক্টোবর মাসের ৪ বা ৫ তারিখ শেষবারের মতো ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। রাত একটার দিকে শরীর হঠাৎ বেশি খারাপ করলে এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিতে নিতে দুইটা বেজে যায়। এম্বুলেন্সে বাবার সঙ্গে ছিলাম আমি আর আমার বাবাকে দেখাশোনা করতো যে ছেলেটি সে।
হাসপাতালে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবাকে আইসিইউতে ভর্তি করে ফেলা হয়। যেহেতু ২০০৩ সালে পড়ে গিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হবার পর থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওই হাসপাতালেই বাবার সব চিকিৎসা হয়েছে, তাই সে হাসপাতালে ডাক্তার নার্স থেকে শুরু করে এম্বুলেন্স চালক, ওয়ার্ড বয় পর্যন্ত সবাই বাবার একমাত্র এটেন্ডেন্ট হিসাবে আমাকেই চিনতো, আমার সঙ্গে ভালোই সখ্য ছিল।
বাবাকে হাসপাতালে নিচ্ছি জেনে ওনার ডাক্তার আগেই আইসিইউতে বলে রাখায় দ্রুতই ভর্তি করতে পারি আমি। ভর্তির সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়া মাত্রই আমার হাতে প্রায় তিন পাতার একটি লম্বা তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই তালিকায় ওষুধ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সবকিছুই ছিল। ছেলেটাকে বাবার কাছে রেখে সেই রাত ৩টায় ওষুধ কিনতে নামি আমি। একা আমি। আল্লাহ্কে অশেষ শুকরিয়া। নিচেই একটা ফার্মেসি ছিল বলে আমাকে এতরাতে রাস্তায় নামতে হয়নি। না হলে কী হতো আমি জানি না।
এতগুলো কথা বললাম কারণ সম্প্রতি চোখে পড়লো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন উদ্ভট এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। সেখানে বলা আছে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে রাত ১২টায় সাধারণ ওষুধের দোকান বন্ধ করতে হবে। আর ‘হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত নিজস্ব ওষুধের দোকান’ রাত দুইটায় বন্ধ করতে হবে। বলা বাহুল্য এটা নিয়ে নানা মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এমন সমালোচনার মুখে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি ডিএসসিসি’র নির্দেশনা নাকচ করে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা রাখা যাবে বলে জানান। কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যের পরও নিজেদের বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করেনি ডিএসসিসি। সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা জানান, মন্ত্রীর বক্তব্যের পরও তারা নিজেদের অবস্থানে অটল। ১লা সেপ্টেম্বর থেকে তাদের নির্দেশনা মেনেই ফার্মেসি বন্ধ হতে হবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন তারা।
এরপর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস রীতিমত ‘বোমা ফাটান’। ৩০শে আগস্ট বিকালে নগর ভবনের মেয়র হানিফ অডিটরিয়ামে ডিএসসিসির দ্বিতীয় পরিষদের ষোড়শ করপোরেশন সভায় বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে সংযুক্ত ওষুধের দোকান ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার যৌক্তিকতা আমরা দেখি না। কারণ যেখানে রবি থেকে বৃহস্পতিবার সুনির্দিষ্ট সময়ের পর, শুক্র-শনিবার এবং রাতে চিকিৎসকই পাওয়া যায় না সেখানে ওষুধের দোকান কেন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হবে? আগেতো চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে। তারপরতো চিকিৎসাসেবার জন্য ওষুধের দোকান খোলা রাখতে হবে’। তার এই বক্তব্যে যাবার আগে তার বিষয়ে আমার ছোট একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।
মেয়র তাপস ২০০৯ সাল থেকে মেয়র হবার আগ পর্যন্ত ধানমণ্ডি আসনে ভোটে অথবা বিনা ভোটে সংসদ সদস্য ছিলেন। আমি এলিফ্যান্ট রোডের বাসিন্দা হিসেবে আমার গলিতে অবৈধ স্থাপনা এবং আমার বাড়ির মেইন গেটের সামনে মাল্টিপ্ল্যান মার্কেটের মালবাহী পিকআপ এর (যেগুলো পুরো গলিটিকে বন্ধ করে রাখে) বিষয়ে তাকে বারবার অভিযোগ করি। তিনি প্রতিবারই বলেন, এটি সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এবং মেয়রের আওতাভুক্ত। সে কারণেই তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি যখন মেয়র নির্বাচনে (!) দাঁড়ান, তখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির ‘আজকের বাংলাদেশ’ নামক টক শোতে আমার সঙ্গে অংশ নেন এবং আমার প্রশ্নের জবাবে স্বতপ্রণোদিত হয়ে জাতির সামনে ওয়াদা করেন, তিনি মেয়র নির্বাচিত হলে এই সকল অবৈধ স্থাপনা (দোকান) সরাবেন এবং আমার বাড়ির গলি বন্ধ করে রাখা মার্কেটের মালবাহী পিকআপ ঢোকা বন্ধ করার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন। তিনি নিজেই জাতিকে জানান যে তিনি আমার এলাকার এমপি থাকা অবস্থায় আমি এ বিষয়ে তার হস্তক্ষেপ কামনা করি।
জনাব তাপস মেয়র হয়েছেন, প্রায় আড়াই বছর হলো। নগরপিতার দেখা পাবো, কিংবা তার নাগাল পাবো, সরাসরি কথা বলতে পারবো এতবড় সৌভাগ্য নিয়ে আমার মতো আমজনতা এদেশে জন্মায়নি। শেষমেশ তার পিএসই ভরসা। তাকে দফায় দফায় অভিযোগ জানিয়ে, সরজমিন ছবি পাঠিয়ে আজ অবধি কোনো সুরাহা হয়নি। বহাল তবিয়তে যেমনি চলছে অবৈধ স্থাপনার দোকান (যেগুলো অবৈধ হবার কারণে এক এগারো সরকার ভেঙে দিয়েছিল) তেমনি আছে আমার বাড়ির মূল গেটে বাধা তৈরি করে পুরো গলি জুড়ে পার্কিং করা মার্কেটের মালবাহী পিকআপগুলোও। তাপস সাহেব এমপি থাকাকালীন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বাধা হিসাবে যেভাবে সাবেক মেয়র সাইদ খোকনকে দেখিয়েছিলেন, সম্ভবত সেই কারণ, সেই বাধা আজও দূর হয়নি।

যাক ফিরে আসি তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি বলেছেন রবি থেকে বৃহস্পতিবার সুনির্দিষ্ট সময়ের পর, শুক্র-শনিবার এবং রাতে চিকিৎসকই পাওয়া যায়না। তাপস সাহেব ‘রাজ পরিবার’ এর সন্তান, এদেশে চিকিৎসা নেবার সুযোগ হয়তো তার হয়নি। তাই তিনি জানেন না প্রতিটি হাসপাতালে (সরকারি কিংবা বেসরকারি) ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার থাকে। আমি বলছি না বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে ডিউটি করেন কিন্তু নিদেনপক্ষে একজন এমবিবিএস ডাক্তার সব হাসপাতালেই নিয়ম করে থাকে। রাতে যদি ডাক্তার পাওয়া না যায়, তাহলে রাতে ঢাকা শহরে কেউ অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা দেয় কারা? রাতে হাসপাতালগুলোতেই বা কারা চিকিৎসা দেয়? এই শহরের হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতেই শুধু নয়, প্রতিটি ওয়ার্ডে রাতের বেলায় কয়েকজন ডাক্তার ডিউটিতে থাকেন। আইসিইউতে ডাক্তাররা থাকেন। সারারাত অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তাররা রোগীদের জরুরি অপারেশন করেন। সারারাত গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি করানো হয়।
এই তথ্যগুলো জানার জন্য মেয়র হবার প্রয়োজন নেই, এই দেশে বাস করা ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ হওয়াই যথেষ্ট। সুতরাং ঠিক কিসের ভিত্তিতে তিনি এই মন্তব্য করেছেন আমি জানি না। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি তার এই বক্তব্যের পর আমাদের চিকিৎসক সমাজের প্রতিক্রিয়া দেখে। বাংলাদেশে আমি যতদূর জানি অনেকগুলো সংগঠন আছে ডাক্তারদের। কোনো সংগঠন থেকে শক্ত ভাষায় এই বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কয়েকজন ডাক্তার ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেখলাম কিন্তু সাংগঠনিকভাবে কোনো বক্তব্য ডাক্তারদের তরফ থেকে নজরে আসেনি।
আচ্ছা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে হাসপাতাল কয়টি আছে? এসব হাসপাতালের সঙ্গে থাকা ফার্মেসির সংখ্যাই বা কতো? এই ফার্মেসিগুলো কতোটা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে? রাত ২টার পর বিদ্যুতের সর্বনিম্ন চাহিদার সময়ে ফার্মেসিগুলো বন্ধ রেখে মেয়র কী অর্জন করতে চাইছেন? শুধু হাসপাতালের সঙ্গে থাকা ফার্মেসিই বা কেন? মানুষের অসুস্থতা তো বলে কয়ে আসে না। আর সব অসুস্থতায় হাসপাতালে যাবারো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মানুষ জানে কিছু ওষুধের দোকান সারা রাত খোলা থাকে, হঠাৎ অসুস্থ হলে মানুষ সেখানে ওষুধ নিতে যায়। বাড়িতে বয়স্ক অসুস্থ মানুষ নিয়ে আমার মতো অনেকেই থাকেন। আমাদের মতো মানুষদের জন্য একটা বড় ভরসার জায়গা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা এই ফার্মেসিগুলো।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের অজুহাতে এই ফার্মেসিগুলো বন্ধ রাখার কথা বলছেন মেয়র। আমার প্রশ্ন হলো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা কতটা খারাপ হলে অল্প কিছু ফার্মেসির দুইটা বাতি আর একটা ফ্যান বন্ধ করার পেছনে আদাজল খেয়ে লাগতে হয় সরকারকে, যেখানে মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন সরাসরি জড়িত? স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, থিংকট্যাংকসহ সকল বিরোধী দল যে দাবি করে আসছে দেশ শ্রীলঙ্কার পথে রওনা দিয়েছে মেয়রের এই সিদ্ধান্ততো সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
একটা রাষ্ট্রে উদার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থাকলে সেটি পুরো রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে, সমাজকে এবং ব্যক্তিকে গণতান্ত্রিক করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই ঠিক উল্টোটা ঘটে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন দল/গোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষকেও স্বৈরতান্ত্রিক করে তোলে। তাই এমন ব্যবস্থার অধীনে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানও তার নিজেকে একজন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে দেখতে চান। আর সব স্বৈরাচারী মানুষ হয়ে থাকেন ইগোসেন্ট্রিক। নিজে যা বলেছেন, করেছেন, সেটা ভুল হয়েছে বুঝতে পারলেও তাদের পক্ষে সেটা স্বীকার করা সম্ভব হয় না, সংশোধন তো পরের কথা। স্বৈরাচার টিকে থাকে শক্তির ভিত্তিতে। ভিন্নমতের প্রতি বিবেচনাবোধ দেখানো স্বৈরাচারীকে নিজের কাছে দুর্বল করে। বাংলাদেশে গত কয় বছরে যে ফ্যাসিজম গেড়ে বসেছে তাতে শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষই নয় বরং আশপাশে থাকা সকলেই নিজেকে এক একজন ঈশ্বর ভাবতে শুরু করেছে। ঈশ্বর তো যেকোনো সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় নিতে পারেন, আর ঈশ্বর কখনো ভুল করেন না।
২০১২ সালে শুধু ওই একদিন না, বাবার অসুস্থতা নিয়ে এর আগেও আমাকে বারবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে। গভীর রাতে (রাত ২টার পরও) অনেকবার ওষুধ কেনার অভিজ্ঞতা আছে আমার। ঢাকা দক্ষিণের ফার্মেসিকাণ্ড দেখে আমার বারবারই মনে হচ্ছে ভাগ্যিস সে সময়ে শেখ তাপস মেয়র ছিলেন না! এটা লিখে আবার মনে হলো এখন তো আছেন তিনি। নিজে অসুস্থ হবার কথা আপাতত সরিয়ে রেখে নতুন আতঙ্ক মাথায় ঢুকলো মাকে নিয়ে।
বয়স্ক, অসুস্থ মাকে নিয়ে আমার জীবনযাপন। যেকোনো মুহূর্তে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন তিনি, নিতে হতে পারে হাসপাতালে কিংবা নিদেনপক্ষে যেকোনো সময় প্রয়োজন পড়তে পারে ইমার্জেন্সি মেডিসিনের। সর্বশেষবার হার্টের সমস্যার জন্য তাকে ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। তবে সেটা ছিল দিনের বেলা। এবার যদি অসুস্থ হন গভীর রাতে? আমার মাকে তো চিকিৎসা নিতে হবে আমার বাবার মতোই, এই দেশে। ওষুধটা অন্তত কিনতে পারবো তো? শেখ তাপসের মতো হাতেগোনা কিছু মানুষ বাদ দিলে এয়ার এম্বুলেন্স আনিয়ে মরণাপন্ন অবস্থায় মাকে থাইল্যান্ড/সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করানো আর সব মানুষের মতোই আমার কাছেও দিবাস্বপ্নের চেয়ে বেশি কিছু না।