১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসা ছিল। এই ৮০ হাজার মক্তব-মাদরাসার জন্য বাংলার চার ভাগের এক ভাগ জমি লাখেরাজভাবে বরাদ্দ ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এই লাখেরাজ সম্পত্তি আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং জোর-জবরদস্তি করে দেশের হিন্দু জমিদার ও প্রজাদের ইজারা দিতে থাকে। এসংক্রান্ত তিনটি বিধান হলো : (১) ১৭৯৩ সালের রেগুলেশন—১৯, (২) ১৯১৮ সালের রেগুলেশন—২, (৩) রিজামসান ল অব ১৮২৮ (লাখেরাজ ভূমি পুনঃ গ্রহণ আইন)।
ফলে মাদরাসার আয় কমতে থাকে। বহু মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। গুটিকয়েক মাদরাসা কোনোভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ১৭৬৫ সালে বাংলায় মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার। ২০০ বছর পর ১৯৬৫ সালে এ সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নেমে আসে।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, মাদরাসা শিক্ষা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিমিটেড, চট্টগ্রাম-ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ : মে-২০০২, পৃষ্ঠা ৩-৪)
এ ব্যাপারে উইলিয়াম হান্টারের বক্তব্য হলো—‘শত শত মুসলমান পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাদের শিক্ষাপ্রণালী, যা এত দিন লাখেরাজ ওয়াকফের জমিজমার ওপর নির্ভরশীল ছিল, মারাত্মক আঘাত পেল। মুসলমান আলেমসমাজ (ওয়াকফের জমিজমার মামলা নিয়ে) প্রায় ১৮ বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।’ (উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১২১-১২২)
মাদরাসাকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল, হান্টারের মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। হান্টার লিখেছেন : ‘এ দেশটা আমাদের হুকুমতে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসনের ব্যাপারেই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল। ভারতের যে প্রসিদ্ধ (ইংরেজ) রাষ্ট্রনেতা তাদের ভালোভাবে জানেন, তাঁর কথায় : ভারতীয় মুসলমানদের এমন একটা শিক্ষাপ্রণালী ছিল, যেটা আমাদের আমদানি করা প্রণালীর চেয়ে কোনো ক্রমেই ঘৃণার যোগ্য ছিল না। তার দ্বারা উচ্চস্তরের জ্ঞান বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচ্ছন্ন হতো। সেটা পুরনো ছাঁচের হলেও তার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ছিল এবং সেকালের অন্য সব প্রণালীর চেয়ে নিঃসন্দেহে উৎকৃষ্ট ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থায়ই তারা মানসিক ও আর্থিক প্রাধান্য সহজেই অধিকার করেছিল।’ (উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্ঠা ১১৬)
এদিকে মাদরাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ইংরেজরা তাদের মতো করে মুসলমানদের ধর্ম শেখানোর জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে। এ জেড এম শামসুল আলম এ বিষয়ে লিখেছেন : ‘ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে ক্যালকাটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ক্যালকাটা মাদরাসার মুসলিম অধ্যক্ষ ছিলেন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ১৪৭ বছর পর ১৯২৭ সালে নিযুক্ত শামসুল উলামা কামালুদ্দিন আহমদ। তৎপূর্বে প্রথম অধ্যক্ষ ড. এ স্পেন্সার থেকে আলেকজান্ডার হেমিলটন হার্লি পর্যন্ত ২৫ জন অধ্যক্ষ ছিলেন ইংরেজ খ্রিস্টান। ১৭৮০ সালে মাদরাসা স্থাপিত হওয়ার পর ১৭৯০ পর্যন্ত ১০ বছর ক্যালকাটা আলিয়া মাদরাসার পাঠ্যতালিকায় দারসে নেজামিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল। অতঃপর মাদরাসা সিলেবাস থেকে হাদিস, তাফসির বাদ দেওয়া হয়। ১১৮ বছর পর ১৯০৮ সালে ক্যালকাটা আলিয়া মাদরাসায় হাদিস, তাফসির শিক্ষা চালু করা হয় এবং সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে নাম দেওয়া হয় টাইটেল।’ (এ জেড এম শামসুল আলম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪)
ধীরে ধীরে কলকাতা আলিয়ায় পড়ুয়া ছাত্ররা ‘মডারেট মুসলিম’ হতে শুরু করে। হান্টারের জবানিতে দেখুন : ‘ইংরেজি বা বিজ্ঞানে তাদের মোটেই ঔত্সুক্য নেই, ফারসিতে একটু-আধটু আছে। শুধু আরবি ব্যাকরণের খুঁটিনাটি ও ইসলামী আইনের প্রতিই তারা অনুরক্ত। বাড়িতে তারা নিজেদের স্বল্প জমিজমা চাষ করে কিংবা নৌকা চালায়। আর ব-দ্বীপের জেলাগুলোর কথা অমার্জিত গ্রাম্য ভাষায় বলে, যা কলকাতার মুসলমানদের মোটেই বোধগম্য নয়। এই হলো নতুন ছাত্রের রূপ। কয়েক বছরের মধ্যে সে অমার্জিত বুলি ভুলে যায়, দাড়ি ছাঁটাই করতে থাকে এবং মুসলমান আইনের তরুণ বক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে থাকে।’ (উইলিয়াম হান্টার, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩২)
এখানে আমরা দেখতে পাই, আগের ঐতিহ্যবাহী মূলধারার মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি কলকাতা আলিয়ার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষার আরেকটি ধারা চালু হয়। এর বাইরেও ব্রিটিশরা তৃতীয় আরেকটি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। এভাবে পাক-ভারত উপমহাদেশে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়।