Friday, September 22, 2023
spot_img
Homeবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিব্যবসায়ীদের হিসাব রাখার অ্যাপ টালিখাতা

ব্যবসায়ীদের হিসাব রাখার অ্যাপ টালিখাতা

শুরু যেভাবে

প্রতিটি মুদির দোকানেই থাকে বড়সড় একটি খাতা। প্রতিটি পাতায় ভরা থাকে সারা দিনের বিক্রির হিসাব, সারা মাসের বেচাকেনার তালিকা। খাতার কিছু পাতায় জায়গা করে নেয় বাকির হিসাব, কোন ক্রেতার কাছে পাওনা কত! ডিজিটালভাবে সেই হিসাব-নিকাশ রাখার জন্যই আসলে দেশি প্রতিষ্ঠান প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেডের তৈরি করা ‘টালিখাতা’র শুরু। আর অ্যাপটির শুরুর কথা জানালেন টালিখাতার প্রধান নির্বাহী শাহাদাত খান, ‘আমার বন্ধু তুহিন ৩০ বছর ধরে খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে রফিকের মুদি দোকানে বাসার বাজার করে আসছেন।

তাঁর হাতে তিন সপ্তাহের বাকির রসিদ দেখে হয়ে পড়ি হতবাক। দোকানদারের সপ্তাহের ব্যালান্স বা জের তুলতে ভুল হয়েছে, যে কারণে তাঁর সেখানেই ক্ষতি হচ্ছে ৭০০ টাকা। বাকি বিক্রি করাই একটা বাড়তি চিন্তার বিষয়। এরপর যদি হিসাব লিখতে ভুলে যায়, সেটা তো বিশাল এক ক্ষতি। স্মার্টফোনের ডিজিটাল যুগে এটা মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক তখনই মাথায় আসে, দোকানদারদের জন্য একটা অ্যাপ বানাতে হবে। ’

আর এভাবেই টালিখাতার যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালের জুনে। যাত্রার শুরুতে ধারণাও করা যায়নি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এর মধ্যেই আসলে কতটা ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছেন। ফলে মাত্র দুই বছরের কম সময়ে অ্যাপটির ইউনিক ডাউনলোড এসে দাঁড়ায় ৫০ লাখে। দেশের এক কোটির বেশি ছোট ব্যবসায়ীর হিসাব রাখার জন্য সহজ এক অ্যাপ। আর যাতে দোকানদারকে জেরে ভুল করার জের টানতে না হয়।

কী আছে টালিখাতায়

গুগল প্লে স্টোর থেকে বিনা মূল্যে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে, ইনস্টলের পরপরই শুরু করা যাবে ব্যবহার। কিনতে হবে না কোনো সেবা। অ্যাপটির পুরো ইন্টারফেসই করা হয়েছে বাংলায়, ইংরেজি জানার প্রয়োজন একেবারেই নেই। ছোট ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে পাড়ার ছোট দোকানদারদের সব ধরনের হিসাব রাখার জন্য সহজ অ্যাপ এটি। এর মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী নগদে বিক্রি, বাকি বেচাকেনা, নগদ বা বাকিতে কম্পানি থেকে মাল কেনা, দোকানের খরচ ইত্যাদি লেনদেন রেকর্ড করতে পারেন। বাকিতে বিক্রির ক্ষেত্রে কাস্টমারের কাছে সঙ্গে সঙ্গে একটি এসএমএস চলে যায়। ব্যবসার আয়-ব্যয়ের চিত্র চোখের সামনে থাকে।

সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিচার বলা যায় বাকির লেনদেনের মেসেজ। টালিখাতা অ্যাপে বাকির কাস্টমার বা গ্রাহকের তালিকা তৈরি করা যায়। তারপর কোনো কাস্টমার বাকিতে পণ্য কিনলে সেখানে বাকির পরিমাণ লেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমার এসএমএসের মাধ্যমে বাকির হিসাব পেয়ে যাবেন। ফলে দোকানদার ও কাস্টমারের মধ্যে কোনো ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি হয় না।

ইন্টারনেট ছাড়াও টালিখাতা অ্যাপে হিসাব লিখে রাখা যায়। এতে যাঁরা সব সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না বা যেসব এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধা ভালো নয়, সেসব এলাকায়ও এটি কাজ করে থাকে। তবে টালিখাতা অ্যাপে রাখা হিসাবের সব তথ্যের ব্যাকআপ সুবিধা পেতে হলে ইন্টারনেটে অন্তত কিছুদিন পর পর হলেও সংযুক্ত হতে হবে। অ্যাপ ডিলিট হলে বা ফোন হারিয়ে গেলে, টালিখাতা অ্যাপটি আবার ডাউনলোড করে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে লগইন করলে সর্বশেষ ব্যাকআপে থাকা সব হিসাব ফেরত পাওয়া যাবে।

হিসাবের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরিও টালিখাতার অন্যতম বড় ফিচার। অ্যাপে ইনপুট দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নিজ থেকেই যোগ-বিয়োগ হয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের রিপোর্ট, যেমন—দৈনিক বেচাকেনা, দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মোট দেনা-পাওনা, ক্যাশ রিজার্ভের অবস্থা এবং আরো অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

এখন পর্যন্ত টালিখাতা অ্যাপে দোকানদার তাঁর ব্যবসার সব হিসাব অ্যাপের মাধ্যমে রাখতে পারছেন। ভবিষ্যতে অ্যাপটিতে দুটি বড় বিষয় যোগ করা হবে, সেটি নিয়েই এখন কাজ চলছে। একটি হচ্ছে টালিখাতা অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা।

‘টালি পে’ নামে ডিজিটাল পেমেন্ট সেবাটি চালু করা হবে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পাবেন একটি কিউআর কোড। এটি দিয়েই ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেনের মাধ্যমে করতে পারবেন বেচাকেনা। কাস্টমারের কাছ থেকে যেমন পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন, তেমনি তাঁরা সাপ্লাইয়ারদের পেমেন্টও করতে পারবেন নগদ টাকা ওঠানো ছাড়াই। এর মাধ্যমেই পেমেন্ট লিংক পাঠিয়ে বাকি নেওয়া কাস্টমারের কাছ থেকে পাওনা অর্থও আদায় করা যাবে। এ ছাড়া অনলাইনে কেনাকাটা, যেকোনো ধরনের বিল দেওয়া এবং মোবাইল রিচার্জও করা যাবে টালি পে থেকেই, সেটিকে ভিত্তি করে বাড়তি উপার্জনও করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সঠিক পরিমাণে ঋণ জোগাড় করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে প্রায় সময়ই তাঁদের নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বদলে প্রতারকচক্রের হাতে পড়তে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দুই ধরনের ঋণ পদ্ধতি চালু আছে। ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত নিয়ে ঋণ দিয়ে থাকে। অন্যদিকে মাইক্রোক্রেডিট সংস্থাগুলো সমিতির মাধ্যমে গ্রুপ লেন্ডিং পদ্ধতিতে সদস্যদের ঋণ দিয়ে থাকে। টালিখাতার মাধ্যমে দেশে নতুন, তথ্যভিত্তিক ঋণ পদ্ধতি চালু করা নিয়ে কাজ চলছে। অ্যাপটি ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁদের একটি বৈধ বিজনেস প্রফাইল তৈরি করছেন ব্যবসায়ীরা। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাঁর লেনদেনের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং ডিজিটাল ছবি ও ডকুমেন্ট ব্যবহার করে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পদ্ধতিটি ব্যবহার করে সরাসরি ব্যাংকই কম খরচে ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে পারবে। কমাতে পারে অপারেশন খরচ এবং কমাতে পারে খেলাপি ঋণের হারও। কেননা গবেষণা অনুযায়ী ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণখেলাপির হার অনেক কম। এ ছাড়া টালিখাতা ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য আরো নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসবে।

ডাউনলোড লিংক

দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্ল্যাটফরমটি তৈরি হওয়ায় বর্তমানে শুধু অ্যানড্রয়েডের জন্যই পাওয়া যাচ্ছে টালিখাতা। ভবিষ্যতে হয়তো অ্যাপল ব্যবহারকারীদের জন্যও অ্যাপটি তৈরি করবে প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড, তবে শিগগিরই তা হচ্ছে না। ১৩ মেগাবাইটের অ্যাপটি বিনা মূল্যে ডাউনলোড করা যাবে এই লিংক থেকে—https://cutt.ly/xFoLGbA

প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেডের কর্মীরা

প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেডের কর্মীরা

বাংলাদেশের ‘ফিনটেক’ বা ফিন্যানশিয়াল টেকনোলজি ক্ষেত্রটিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা কম্পানিগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রগতি সিস্টেমস লিমিটেড। প্রায় এক যুগ আগে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে কম্পানিটি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একদল প্রযুক্তিবিদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল যাত্রা। প্রযুক্তি ও ব্যাবসায়িক—দুটি জ্ঞানকেই কাজে লাগিয়ে কিভাবে ফিন্যান্সকে ডিজিটাল করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তারা। বিভিন্ন রকমের মোবাইল ব্যাংকিং সফটওয়্যার, ডিজিটাল হিসাব রাখার অ্যাপ, ডিজিটাল ওয়ালেট ইত্যাদি পরিষেবার মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ তাদের সেবা গ্রহণ করছে। এর মধ্যে টালিখাতা ছাড়াও আছে টালি পে ও শিওরক্যাশ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments