চিলির বিশ শতকের সেরা লেখকদের অন্যতম রবার্তো বোলানো। তিনি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, সাহিত্য সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছেন। তাঁর তুলনা চলে বোর্হেস, কোর্তসার প্রমুখের সঙ্গে। তাঁর লেখা যেমন শিল্পমানে উঁচু স্তরের, তেমন সুখপাঠ্যও। সুন্দর, চমৎকার এবং ঝাঁজালো লেখার স্রষ্টা বোলানোর ব্যক্তিজীবনও ছিল বহু বর্ণিল। বেশি মাত্রায় অনন্য। বোলানোর জন্ম ১৯৫৩ সালে সান্টিয়াগোতে। একদম শিকড় থেকেই আলাদা ছিল তাঁর জীবন—বোলানোর বাবা ছিলেন ট্রাকচালক, বক্সার এবং শিক্ষক। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে চিলির উপকূলীয় এলাকায়। তখন তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য ছিল অতিশয় নাজুক; হালকা-পলকা চেহারার বোলানোর দৃষ্টিশক্তি ছিল খুবই দুর্বল। দূরের জিনিস দেখতে পেতেন না। তবে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল ছেলেবেলা থেকেই। স্কুলে সবল-শক্তিধর সহপাঠীরা সুযোগ পেলেই বিরক্ত করত তাঁকে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হলেও তাঁর মায়ের বই পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল। মূলত মায়ের কাছ থেকেই তৈরি হয়েছিল বইয়ের প্রতি টান।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সে বাসের টিকিট বিক্রির কাজ করতে হয় তাঁকে। ১৯৬৮ সালে পরিবারের সঙ্গে মেক্সিকোতে চলে যান। সেখানে গিয়ে পড়াশোনা শেষ না করেই স্কুল থেকে ঝরে পড়েন। এরপর সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে—১৯৭৩ সালে তিনি মেক্সিকো থেকে চিলিতে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি সালভাদর আইয়েন্দের গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে কাজ করেন এবং বিপ্লব গড়ে তোলার সঙ্গে সক্রিয় থাকেন। আইয়েন্দের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাঁর নামে সন্ত্রাসী তৎপরতার অভিযোগ তোলে পিনোশের শাসন। তাঁকে কারাগারে পাঠনো হয়। তবে বেশিদিন থাকতে হয়নি কারাগারে। মাত্র আট দিন ছিলেন। কারারক্ষী হিসেবে কর্মরত দুজন সাবেক সহপাঠীর দেখা পান বোলানো। তাঁদের সহায়তায় তিনি মুক্তি পান।
জেলখানায় থাকাকালে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁর ওপর হয়তো অত্যাচার চালানো হতে পারে। সরাসরি শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়নি। তবে আশপাশের অন্য অনেকের ওপর চালানো নির্যাতনের শব্দ তিনি শুনতে পান। আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেননি ওই কয়েক দিন। তবে সময় কাটানোর জন্য পড়াশোনা করার মতো একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন পেয়েছিলেন। ম্যাগাজিনের একটা প্রবন্ধই শুধু তাঁর ভালো লাগে। একটা বাড়ি নিয়ে লেখা হয়েছিল সেই প্রবন্ধটা। ওই বাড়িটায় একসময় থাকতেন ওয়েলসের কবি ডিলান টমাস। ওই অভিজ্ঞতা নিয়ে বোলানো লেখেন তাঁর ‘ডিটেক্টিভস’ গল্প। তবে মজার বিষয় হলো, বোলানো যে ১৯৭৩ সালে চিলিতে ছিলেন সে বিষয়ে তাঁর মেক্সিকান বন্ধুরা যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেন। চিলিতে তিনি কোনো কোনো কারণে কুখ্যাতও ছিলেন—ইসাবেল আইয়েন্দে এবং মূলধারার আরো কিছু লেখককে তিনি কঠোরভাবে আক্রমণ করেছেন। চিলিতে তিনি নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। ফলে অনেকের কাছে বর্জনের শিকারও হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে চিলিয়ান-আর্জেন্টাইন ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার এরিয়েল ডর্ফমান বলেন, ‘বর্জনের শিকার হওয়ার ফলে তিনি যাকে তাকে যা খুশি তা-ই বলার অধিকারও পেয়েছেন এবং এই অধিকার একজন লেখকের মঙ্গলজনকই বটে।’
১৯৭৪ সালে চিলি থেকে মেক্সিকোতে যাওয়ার সময় তিনি নাকি এল সালভাদরে কিছুদিন ছিলেন। সেখানে কবি রোক ডালটনের সঙ্গে সময় কাটান। তা ছাড়া শোনা যায়, ফারাবন্দো মার্তি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের গেরিলাদের সঙ্গেও ছিলেন কিছুদিন। ছেলেবেলা থেকেই নাস্তিক ছিলেন বোলানো। ১৯৬০-এর দশকে ট্রটস্কির অনুসারী হন। ১৯৭৫ সালে তিনি মোটামুটি ছোটখাটো একটা কাব্যিক আন্দোলন ইনফ্রারিয়ালিজমের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। মেক্সিকোতে ফিরে আসার পর তিনি মোটামুটি বোহেমিয়ান কবি হিসেবে জীবন যাপন শুরু করেন। সে সময় অন্যদের কাছে তিনি ছিলেন ভয়ের প্রসঙ্গ, কখন মুখ ফসকে কাকে কী বলে ফেলেন এ জন্য সবাই তাঁকে ভয় পেত। ১৯৭৭ সালে তিনি ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং শেষ পর্যন্ত স্পেনে গিয়ে হাজির হন। বিয়েশাদি করে সেখানেই বসতি শুরু করেন। বার্সেলোনার কাছে কোস্টা ব্রাভাতে থালাবাসন পরিষ্কার করা, ক্যাম্পের গ্রাউন্ড তদারকি করা, ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করা—এ রকম কিছু কাজকর্ম করতেন এবং অবসর সময়ে লেখালেখি করতেন। আশির দশক থেকে ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কাতালান তট শহর ব্লানাসে ছিলেন।